প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শেষ হয়েছে কি হয়নি। রাজধানীর সংসদ মার্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দফতরের পাশে পিটিআই ভবনের নীচের এটিএম-গুলিতে লম্বা লাইন পড়ে গেল। শুরু হয়ে গেল ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। শুধু দিল্লি নয়, গোটা দেশের ছবিটা প্রায় এই রকমই।
এবং ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরে আমজনতার এমন নাজেহাল দশা দিনকয়েক চলবে বলে মেনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। খোদ প্রধানমন্ত্রীই সে কথা বলেছেন। পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত পটেল বাজারের নগদের অভাব হবে না বলে দাবি করলেও কেন্দ্রের অর্থ বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাস তাঁর পাশে বসেই বলেছেন, আগামী ১৫ দিন সাধারণ মানুষকে খানিকটা ভুগতে হবে।
বেশি অসুবিধায় পড়বেন কারা? অবশ্যই দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষরা। অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য, বাজারে এখন সবচেয়ে বেশি চলে ৫০০ টাকার নোট। সেই নোট বাতিল হয়ে যাওয়ায় এবং তার বদলে যথেষ্ট ১০০ টাকার নোটের জোগান না-থাকায় গৃহস্থরা হয় তাঁদের কাজ দেবেন না, না হয় আগামী ক’দিন টাকা মেটাবেন না। চা-বাগান বা আবাসনের মতো জায়গায়, যেখানে দৈনিক মজুরিতে অনেকে কাজ করেন, সেখানে বেতন মেটানোর ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা তৈরি হল। কারণ, এই দুই ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় টাকা আগাম তুলে রাখা হয়, এবং তা মূলত ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে। চা-বাগানে শ্রমিকদের খাদ্যশস্য জোগানেও সমস্যা হবে বলে বহু বাগানের ম্যানেজারেরা যেমন আশঙ্কা করছেন, তেমনই আবাসন শিল্পে শ্রমিকদের দৈনন্দিন খাওয়ার খরচ মেটানো নিয়ে চিন্তায় প্রোমোটারেররা।
বস্তুত, হাঁড়ি চড়াতেও সমস্যায় পড়বেন নিচু আয়ের মানুষরা। কারণ, টাকার অভাবে খুচরো বাজারের বিক্রেতারা কাঁচামাল তুলতে পারবেন না। যেটুকু তুলবেন তারও খানিকটা ধারে বেচতে বাধ্য হবেন। ফলে জিনিসপত্রের দাম চড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বিপাকে পড়বেন চাষিরাও। কারণ, সবে ধান কাটা হয়েছে। আগামী ক’দিন তা বিক্রি করা কঠিন হবে। পাশাপাশি চলছে গম ও রবি ফসল বোনার কাজ। তার জন্য সার এবং বীজ কেনাও ধাক্কা খাবে।
মধ্যবিত্তের সমস্যাও কিছু কম নয়। অনেকের বাড়িতেই এখন খুব বেশি ১০০ টাকার নোট থাকে না। কিন্তু আগামী দু’দিন এটিএম থেকে টাকা তোলারও আর কোনও উপায় নেই। বুধ ও বৃহস্পতিবার সব এটিএম বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করে দিয়েছে কেন্দ্র। তার পর দৈনিক দু’হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কাল থেকেই নতুন ৫০০ টাকা ও ২০০০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হবে বলে ঘোষণা করলেও তা সাধারণ মানুষের হাতে আসতে বেশ কয়েক দিন লেগে যাবে। দেশের বাজারে এখন ১৬৫০ কোটি ৫০০ টাকার নোট রয়েছে। ১০০০ টাকার নোট রয়েছে ৬৭০ কোটি। এত নোট রাতারাতি বদলে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তা ছাড়া, এটিএম-গুলিতে প্রযুক্তিগত বদল আনতে হবে বলে জানিয়েছেন নীতি আয়োগের সদস্য, অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায়। কারণ, নতুন ৫০০ ও ২০০০ নোটের মাপ আলাদা হবে। তা ছাড়া, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তো বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির কর্তৃপক্ষের হাতে নতুন টাকা তুলে দিয়ে খালাস! ‘‘দেশের সর্বত্র, বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সেই নোট পৌঁছে দেওয়া বিপুল ঝক্কির এবং সময়সাপেক্ষ কাজ,’’ বললেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্তা।
ঘাবড়াবেন না । বাড়িতে ৫০০, ১০০০ টাকার নোট। ঘাবড়াবেন না। মাথায় রাখুন—
•ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে নিজের অ্যাকাউন্টে যত টাকার খুশি পুরনো নোট জমা দিতে পারেন ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত
• তার পরেও ৩১ মার্চ পর্যন্ত তা জমা নেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কিছু নির্দিষ্ট শাখা। দিতে হবে পরিচয়পত্র
• পরিচয়পত্র দেখালে ২৪ নভেম্বর অবধি ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত অঙ্কের পুরনো নোট বদলাবে যে কোনও ব্যাঙ্ক, ডাকঘর
মোদী আজ তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ‘‘দেশ থেকে কালো টাকা ও জাল নোট উধাও করার জন্য এটুকু ভোগান্তি দেশবাসী সহ্য করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।’’ এখন প্রশ্ন হল, তাঁর পদক্ষেপে এই দুই লক্ষ্য পূরণ হবে কি? কালো টাকা রুখতে তৈরি এসআইটি-র চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম বি শাহ-র মতে, এর ফলে কালো টাকায় সম্পত্তি কেনা বন্ধ হবে। এইচডিএফসি-র চেয়ারম্যান দীপক পারেখের মতে, এ বার যাঁরা বিরাট পরিমাণে নগদ জমা করবেন, আয়কর দফতরের পক্ষে তাঁদের চিহ্নিত করে নজরদারি করা সহজ হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি কালো টাকার লেনদেন হয় আবাসন ক্ষেত্রে এবং জমির কেনাবেচায়। পারেখের মতে, মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে জমির এবং ফ্ল্যাট-বাড়ির দাম কমতে পারে।
কিন্তু অর্থনীতিবিদদের একাংশ এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তাঁরা বলছেন, বিস্তর কালো টাকা রয়েছে এমন ব্যবসায়ীরা প্রায় কেউই নগদ জমিয়ে রাখেন না। সেই অভ্যাস রয়েছে মাঝারি মাপের কালো টাকার ব্যবসায়ীদের। ফলে এই পদক্ষেপ করে গভীর জলের মাছেদের ধরা শক্ত। তাঁদের টাকা হয় রয়েছে বিদেশে, না হয় অলঙ্কারে। বস্তুত, গত লোকসভা ভোটের প্রচারে বিদেশ থেকে কালো টাকা আনার কথাই বলেছিলেন মোদী। দেশে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে বিদেশ থেকে কালো টাকা ফেরানোর কোনও সম্ভাবনাই নেই।
তবে জাল টাকার মোকাবিলায় এই পদক্ষেপ কার্যকরী হবে বলেই অর্থনীতিবিদদের আশা। গোয়েন্দাদের মতে, পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই এ দেশে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা ঢুকিয়েছে। জাল টাকা বড় মাপের নোটে না ছাড়লে পড়তায় পোষায় না। অর্থ বিষয়ক সচিবের যুক্তি, গত পাঁচ বছরে অর্থনীতিতে চালু নোটের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। অর্থনীতির বহর বেড়েছে ৩০ শতাংশ। অথচ পাঁচশো টাকার নোটের সংখ্যা বেড়েছে ৭৬ শতাংশ, ১০০০ টাকার নোটের সংখ্যা ১০৯ শতাংশ। ফলে আয়-ব্যয়ের তুলনায় বড় নোটের ব্যবহার যে মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে, সেটা স্পষ্ট। সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে জাল নোটের সম্ভাবনা। এ দিনের পদক্ষেপে এক ধাক্কায় তা বরবাদ হয়ে গেল।
তথ্য সহায়তা: দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত