নববর্ষের অনুষ্ঠানে শামিল ‘আবোল তাবোল’। ছবি: ফেসবুক।
বাংলার ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়েছে, এমনটা প্রায়ই শোনা যায়। কেউ সেখানে থেকে যায়, আবার কেউ কেউ ফিরে আসে। যাঁরা ফেরেন না, তাঁরা সেখানেই ঘরবাড়ি সাজিয়ে তোলেন। এমনই একদল বাঙালি পড়াশোনার জন্য আস্তানা গড়ে তুলেছেন আর্বানা-শ্যাম্পেনে, যার পোশাকি নাম ক্যাম্পাস শহর। শিকাগো থেকে ২১৮ কিমি দূরত্বে এই শহরের ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় আর্বানা শ্যাম্পেনে কেউ পড়াশোনা করছেন, আবার কেউ গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে গবেষণায় মগ্ন। তবে এই সবের মাঝেই বাংলা ভাষার চর্চায় দিনের একটা সময় বরাদ্দ করেছেন তাঁরা।
শুধু সময় নয়, রীতিমতো ‘আবোল তাবোল’ নামে এক সংগঠনও তৈরি করা হয়েছে। তার সদস্য হিসাবে ভারতের পড়ুয়া তো বটেই, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, কিংবা আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের পড়ুয়ারাও সমান ভাবে গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। তাঁরা সকলে মিলেই নিয়মিত বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে উদযাপন করে থাকে।
বাংলা ভাষা-ই জাগিয়ে রেখেছে সংস্কৃতি চর্চা। নিজস্ব চিত্র।
কিন্তু শুরুটা হল কী ভাবে?
২০২২-এর শুরুর দিকে অয়ন, শৌর্য, ভাস্কররা একটি ছাত্র সংগঠন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। কবি সুকুমার রায়ের লেখা কবিতাই হয়ে ওঠে ওই সংগঠনের নাম। পড়াশোনা এবং গবেষণার কাজের মাঝে চেনাজানা বন্ধু-বান্ধবরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে একটু হাসি মজা করবে, এটা ভেবেই পথ চলা শুরু। তবে, বিদেশ বিভুঁইয়ের নিয়ম অনুযায়ী, পরিচয়পত্র এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক নথি জমা নেওয়াও হয়েছিল। এর পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংগঠনের পরিচিতি বাড়ে। আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে বড় হওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছেলে-মেয়েরাও সংগঠনের সদস্য হতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এখন পূজা, শৌনক, অন্বেষা, তুহিন, শুভাশীষ, উৎসব, সৌনক, সপ্তর্ষি, বিদিশা, অর্ঘ্য, শাশ্বতর মতো মোট ১৫০ জনের বেশি সদস্য নিয়ে বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি চর্চায় ব্যস্ত ‘আবোল তাবোল’।
কী হয় এখানে?
সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে যেমন দেদার আড্ডা চলে, তেমনই পয়লা বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিদেশি বন্ধুদের শামিল করে নেয় ‘আবোল তাবোল’। তাই কেভিন, ক্রিসরাও সুপ্রিয়র কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে যন্ত্রের ছন্দের সঙ্গত দিতে থাকেন। আবার পড়শি দেশের ঢাকায় বেড়ে ওঠা রাকিবের তবলা বা ভায়োলিনের ছন্দে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান ক্যালিফোর্নিয়ার ছেলে সিদ্ধার্থ।
দুর্গা মায়ের কোলে থাকা ডাক্তার - ‘আবোল তাবোল’-এর শ্রদ্ধার্ঘ। নিজস্ব চিত্র।
আরজি কর কাণ্ডের প্রভাব ক্যাম্পাস শহরেও
তবে শুধু আনন্দ উৎসবেই নয়, আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদেও সোচ্চার হয়েছেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সভার ডাক দেওয়ার পাশাপাশি, দুর্গাপুজোর আয়োজনেও সংহতির বার্তা দিয়েছে ‘আবোল তাবোল’। সংগঠনের সদস্য দীপান্বিতার তুলির টানে সেজেছে দুর্গা মায়ের কোলে থাকা ডাক্তারের ছবি।
এই প্রসঙ্গে সংগঠনের সদস্য, সপ্তর্ষি এবং বিদিশা বলেছেন,“এত দূরে থেকে হয়তো আমাদের আওয়াজ সম্পূর্ণ ভাবে পৌঁছনো সম্ভব নয়। কাজের তাগিদে শহরের মিছিলের আবহ থেকেও আমরা অনেক দূরে। কিন্তু এই অস্থির সময়ে এই উদ্যোগটুকুও না থাকলে আয়নায় নিজের ছবি দেখাই কঠিন হয়ে যাবে। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা যেন এ ভাবেই সব সময়ে কথার বলার সাহস পাই।”
ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সভা। ছবি: ফেসবুক।
ভাষার নেই কোনও সীমানা
তবে, শুধু বাংলা ভাষার কাজেই আবদ্ধ নেই ‘আবোল তাবোল’। এ বছর ভাষা দিবসের স্মরণে তৈরি করা ভিডিয়ো কোলাজে ছিল বিশেষ চমক। বাংলা তো বটেই, ইংরেজি, সিলেটের বাংলা, তামিল, পর্তুগিজ— এমন ২০টি আন্তর্জাতিক ভাষাভাষী মানুষ নিজেদের ভাষায় ওই দিনের মর্যাদা ব্যক্ত করেছিলেন। সংগঠনের আরও এক সদস্য শুভাশীষের কথায়, “আমাদের ‘আবোল তাবোল’ প্রত্যেকের কথা বলার ভাষাকেই উদযাপন করতে চায়, তাই এই উদ্যোগ। তবে শুধু অবসর যাপনেই নয়, সব সময়ে সব ভাষাকে সমান ভাবে মর্যাদা দেওয়াই মূল লক্ষ্য।”
রবিস্মৃতি বিজড়িত ‘ক্যাম্পাস শহর’
প্রসঙ্গত, ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় আর্বানা শ্যাম্পেনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৬ সালে কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে যান। ১৯১৩ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। ১৯১২ সালে সেই সূত্রেই এই শহরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নোবেল জয়ী হওয়ার পর তাঁর জন্য এই শহরের চ্যানিং-মুরে-তে প্রথম নোবেল পরবর্তী পাবলিক লেকচারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সময়ে কবি আরবানার হাই স্ট্রিটের দু’কামরার বাড়িতে উঠেছিলেন, কাটিয়েছিলেন বেশ কিছুটা সময়। এখনও সেই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জ্বলজ্বল করছে। চ্যানিং মুরের মঞ্চকে টেগোর চ্যাপেল নামেই সবাই চেনে।
টেগোর চ্যাপেল, চ্যানিং-মুরে। ছবি: সংগৃহীত।
ইন্টারনেট ঘাঁটলেই জানা যায়, বিশ্বের প্রথম ১০০টি ভাষার মধ্যে সপ্তম স্থানে বাংলা ভাষা, যে ভাষায় কথা বলেন ২৬০ কোটির বেশি মানুষ। তাই বাংলা ভাষার উচ্চারণের মিষ্টতা এবং প্রাচীনত্বের চর্চা নিয়ে এখনও গবেষণায় মগ্ন ভাষাতত্ত্ববিদরা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সাগরপাড়ের ক্যাম্পাস শহরে ‘আবোল তাবোল’-এর প্রয়াসে শামিল হয়েছেন অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষরাও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই স্মৃতিবিজরিত শহরেই একদল তরুণ-তরুণী তাঁরই লেখা গান, কবিতা, নাটকে খুঁজে নিচ্ছেন দেশের মাটির গন্ধ।