টানকারা গ্রামে ঢোকার মুখে। নিজস্ব চিত্র।
গ্রামটাই যেন ভেঙে পড়েছে বোর্ডের উপর! ‘বেস’-এর আওতায় পকেটের কাছে বাধ্য শিকারের মতো এসে বসেছে লাল ঘুঁটি, দরকার স্ট্রাইকারের শেষ ছোঁয়াটুকু।
ঘুঁটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল!
“হায় হায়, আমি এক সময় এ সব না তাকিয়ে পকেটে ফেলতাম!” শীতদুপুরে জমজমাট ক্যারম আসরের পাশে এই গণ্ডগ্রামের সঙ্গে একেবারেই বেমানান কর্পোরেট রিভলভিং চেয়ারে (কোনও ভাবে এসেছে, ফেরত যায়নি!) বসে হাহাকার করলেন এখানকার এক গাঁও-বুড়ো। যা বুঝলাম, দেবীপূজকদের (তফসিলি জনজাতি) এই টানকারা গ্রামে তিনিই প্রাচীনতম।
শীত দুপুরের আমেজ পিঠে নিয়ে ক্যারম-আসরে বসা এই গাঁও বুড়ো, দিলীপ রঞ্জিত দেবীপূজককে ভোটের বাজারে টেনে আনতে একটু সময় লাগল। কিন্তু এক বার শুরু করার পরে, একটার পর একটা ঘুঁটি পকেটে! কোনও কালে দিল্লিতে ছিলেন, হিন্দি ভাঙা হলেও বোধগম্য। “লোক দেখানো সব গোশালা খুলেছে সরকারি বাবুরা। গাই-বলদ অসুখে পড়লে কারও টিকির দেখা পাওয়া যায় না। কেউ আসে না। এ বার আমরা এদের নিয়ে করবটা কী? বুড়ো হয়ে গেলে তাদের বেওয়ারিশ ছেড়ে দিতে হয়। এর-ওর খেতে মুখ দেয়।” বলে চলেছেন গাঁও বুড়ো, “আগে আমাদের প্রত্যেক পরিবারের পঁচিশ পশুর চারাগা ছিল। কংগ্রেস আমলে পাওয়া। সব নিয়ে নিয়েছে এই সরকার। তামাম পশু আওয়ারা হয়ে যাচ্ছে। আমরা জমি হারাচ্ছি।” জানা গেল, চারাগা হল খেতের সেই বাড়তি জায়গা যেখানে ২৫টি পশু চরে বেড়াতে পারে।
এখন অবশ্য মানুষের জমিই কেড়ে নিয়ে সরকারি খুঁটি পুঁতে দেওয়ার অভিযোগে সরব এই টানকারা গ্রাম। রাজকোট থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে, ডেমি নদীর ধারে একসময় মূলত তুলোজীবী ছিলেন এখানকার গ্রামবাসীরা। এই গ্রামেরই সন্তান, সমাজ সংস্কারক দয়ানন্দ সরস্বতী ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও এই তফসিলি প্রধান গ্রামের গর্বের কারণ আজও। তাঁকে নিয়ে উৎসবও হয় প্রতি বছর এই গ্রামে শিবরাত্রিতে। তবে এখন ওই গর্বের প্রায় অচল আধুলিটুকুই সম্বল। এঁদের তুলো জীবন ও জীবিকা, খেতি মাঠ সব একে একে হারাতে হয়েছে বিজেপি আমলে। দিনে দু’শো টাকায় মজদুরি সম্বল, তা-ও যখন যেমন জোটে। নতুন উপদ্রব, বলদ হালচাষের অযোগ্য হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বেচা যাবে না এখানে সরকারি নিষেধাজ্ঞায়। অথচ সরকারি ভাতা পাওয়ার কথা যে গোশালাগুলির, তারা যে বেদম ধুঁকছে গোটা গুজরাত জুড়েই, সেটা তো আমদাবাদে বসেই টের পেয়েছি।
শহরের ভিতরে হোক বা জাতীয় সড়ক, পথ দুর্ঘটনা বেড়ে গিয়েছে, শ’য়ে শ’য়ে ষাঁড়-মোষ-বলদ বাহিনী হঠাৎ করে খেত থেকে উঠে আসায়। তটস্থ গাড়ি চালকদের প্রশ্ন করতে সবাই প্রায় একই কথা বলছে। বিষয়টি এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে এটি ভোটের আগে শাসক দলের অস্বস্তির কারণ। গোশালাগুলিকে গত রাজ্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল বুড়ো এবং অসুস্থ হয়ে যাওয়া গরু-বলদদের আশ্রয় ও চিকিৎসার জন্য। বনসকণ্ঠ পিঁজরাপোলের (গোশালা) অছি পরিষদের প্রধান কিশোর দেওড়া অন্যদের নিয়ে সেই টাকার দাবিতে রাস্তায় বসেছেন। জানিয়েছেন, এখনও একটি নয়া পয়সা দেওয়া হয়নি।
এই অনুন্নয়ন এবং অবিচার নিয়ে এই এলাকাগুলিতে ঝাঁপিয়েছেন আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল এবং অনেকটাই স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন টানকারা এবং আশপাশের গ্রামগুলিতে। সেটা বোঝা গেল ক্যারম ছেড়ে চারপাশে ক্রমশ ঘন হওয়া ভিড়ের ভাষ্যে। প্রায় ৭০০ পরিবারের এই গ্রামে পাটিদাররাও আছেন। কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় দেবীপূজক। যাঁদের আর্থিক ধাক্কাটা লেগেছে সবচেয়ে বেশি। যিনি বেস-এর ঝুলন্ত ঘুঁটি একটু আগেই মিস করেছিলেন, সেই রঞ্জিত দেবীপূজক টুনিলাইট লাগিয়ে বেড়ান আশপাশের ধনবান পাটিদারদের উৎসবে। কিন্তু এ হেন উৎসব আর কত দিন? বাকি সময় যা পান তা-ই করেন পেটের দায়ে। “গত কুড়ি বছর ধরে বিকাশের কথা শুনছি। কোথায় বিকাশ? প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় যে গাঁয়ে পাঁচশো ঘর, সেখানে আসলে মাত্র পনেরো জনকে দিয়ে চ্যানেলে ঘটা করে দেখায়।” তাঁর কথায়, “আপ দিল্লিতে কী কাজ করেছে তা আমরা দেখেছি। আমাদের ভরসা আছে ওদের উপর। এ বারে হয়তো হবে না, পরের বার গুজরাতে বদল আসবে।”
ভিড় সমস্বর, শুধু বিজেপি কেন কংগ্রেসও কিছুই করেনি এই অঞ্চলে। গাঁও বুড়ো বলছেন, “এখন এখানে বিধায়ক ললিত ভাই কংগ্রেসের। শুধু ভোটের সময় এসে হাত নেড়ে, বড় বড় কথা বলে চলে যায়। পাঁচ বছর পাত্তা নেই।” প্রবীণ দেবীপূজক তাঁর বাপ-পিতেমোর জমি হারিয়েছেন কাগজ ঠিকমতো না থাকার জন্য। তিন-চার পুরুষের জমিতে এখন সরকারের সিলমোহর লেগে গিয়েছে। “এখানে নাকি বিকাশ হবে। আমাদের অধিকাংশের কাছেই একশো বছর আগের পাওয়া জমির কাগজ নেই। যুগের পর যুগ এখানেই আমাদের চাষবাস, গড়াগড়ি খাওয়া, বড় হওয়া, বাচ্চা বড় করা, বকরি চরাতে যাওয়া। এখন শুনতে হচ্ছে এই জমি নাকি আমাদের নয়! বুঝুন বিষয়খানা।”
কেজরীওয়াল এসে এখানে বলে গিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে জমি ফেরাতে লড়বেন, বিদ্যুৎ বিনামূল্যে করে দেবেন যেমনটা নাকি করেছেন দিল্লিতে। প্রবীণের কথায়, “আমার ঘরে দুটো পাখা, তিনটে বাতি আর একটা টিভি চলে। তাতেই দু’মাসের মিলিয়ে বিজলি বিল এসেছে ৪৮০০ টাকা! এখন বিল নিয়ে শহরে দৌড়চ্ছি দু’বেলা, দিনমজুরি ফেলে রেখে।”
শুধু তুলো নয়, এক সময় টানকারা ছিল রুপো উৎপাদনে অগ্রণী। এখন তার ঔজ্জ্বল্য ফিকে। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কোনও সম্বল নেই।