কৃষি বিলের প্রতিবাদে বিরোধী সাংসদদের মিছিল। বুধবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
কৃষি বিলকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্ব, আজ সংসদ চত্বরে দফায় দফায় ধর্না, বৈঠক, রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনের মাধ্যমে শেষ হল। এর পর একে রাজ্য এবং জেলাস্তরে এই আন্দোলন ছডি়য়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি।
রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, এই বিলকে কেন্দ্র করে রাজ্যসভায় যে ভাবে আগাগোড়া মসৃণ থেকেছে মোদী বিরোধী সার্বিক ঐক্য, লোকসভায় তা দেখা যায়নি। সেখানে কংগ্রেস এবং তৃণমূল একত্রে ধর্নায় সামিল হয়নি। এমনকি, বিকেল পাঁচটার শেষ ধর্নায় যখন লোকসভার সব বিরোধী দল গাঁধী মূর্তির পাদদেশে বসে, তখন সেখানে থাকেনি তৃণমূল এবং টিআরএস। আবার রাষ্ট্রপতিকে লেখা ১৭টি বিরোধী দলের চিঠিতে (কৃষি বিল সই না করে সরকারকে ফেরত পাঠানোর দাবি সম্বলিত) শিবসেনা সই করলেও বিরোধীদের বয়কটে যোগ না দিয়ে, শেষ পর্যন্ত অধিবেশনে হাজির থেকেছে।
তবু দিনশেষে বিরোধী মহলের একাংশের দাবি, এই আন্দোলনকে যে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে, তা, সংসদ শুরুর সময়ে ভাবা যায়নি। বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বার বার এক ছাতার তলায় আসতে গিয়ে নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছে আগে। তা সত্ত্বেও একটি বিল পাশকে কেন্দ্র করে সংসদ থেকে যে আন্দোলন শুরু হল, তাতে মোটের উপর কংগ্রেস, তৃণমূল, টিআরএস, ডিএমকে, এসপি-সহ প্রায় সব বিরোধী দলেরই সিলমোহর পাওয়া গিয়েছে। বিজেপি-র শরিক এবং বন্ধুদের মধ্যে ফাটল ধরানো গিয়েছে। আপ, কংগ্রেস, বাম এবং তৃণমূলের সাংসদেরা পাশাপাশি রাত কাটিয়েছেন সংসদ চত্বরে, খোলা আকাশের তলায়। অথচ এই সংসদীয় অধিবেশন শুরুর সময়ই পশ্চিমবঙ্গের ভোটকে সামনে রেখে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের সংঘাত প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল। তৃণমূলের নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রীকে সকালে উঠে চা নিয়ে টুইট করতে হচ্ছে! এর থেকেই স্পষ্ট যে তিনি নজর ঘোরানোর জন্য কতটা মরিয়া।’’
আরও পড়ুন: নতুন কৃষি বিল: কী কী হচ্ছে, কী কী বদলাচ্ছে, কী কী বলছে দু’পক্ষ
আরও পড়ুন: অতিমারির অধিবেশন শেষ অচেনা সংসদে
আর আজ বিকেলে রাষ্ট্রপতিভবন থেকে বেরিয়ে গুলাম নবি আজাদ বলেন, “রাষ্ট্রপতিকে জানালাম, রাজ্যসভায় আইন মোতাবেক এই বিল পাস করা হয়নি। এই বিল অসাংবিধানিকভাবে জোর করে পাশ করিয়েছে সরকার। আপনি দয়া করে বিষয়টি বিবেচনা করে একে ফেরত পাঠিয়ে দিন। যাতে সংসদে ফের আলোচনা করে সংশোধনীগুলি আনা সম্ভব হয়।’’
পূর্ব পরিকল্পনামাফিক আজ সকাল ১১টার সময় কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদের ঘরে বৈঠক করেন রাজ্যসভার বিরোধী নেতারা। কোভিড বিধি অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির কাছে একসঙ্গে পাঁচ জনের বেশি না যাওয়ার অনুমতি না থাকায় প্রাথমিক ভাবে স্থির হয়, কংগ্রেস, তৃণমূল, টিআরএস, ডিএমকে এবং এসপি-র সংসদীয় নেতারা যাবেন। সূত্রের খবর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেককে নির্দেশ দেন যে বিরোধী ঐক্য মজবুত রাখার জন্য তৃণমূল ওই প্রতিনিধি দল থেকে নিজেকে সরিয়ে, সংখ্যায় ছোট একটি দলকে সুযোগ দিক। সেই মর্মে ডেরেক কথাও বলেন গুলামের সঙ্গে। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃ্ত্বের রাজনৈতিক কৌশল ছিল, শিবসেনা (হিন্দুত্ববাদী দল) অথবা টিআরএস (যারা মোদী সরকারের দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছে)-কে এই প্রতিনিধি দলে সামিল করা। তবে বাম সাংসদেরা বলেন যে যেহেতু মাত্র পাঁচ জনই সুযোগ পাচ্ছেন যাওয়ার, একা তৃণমূল সরে দাঁড়ালেই বাকি এতগুলি দলের সামনে প্রতিনিধিত্ব করার দরজা খুলবে না। পরে সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয়, রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা হিসাবে গুলাম নবি একাই যাবেন।
এর পর আজ দফায় দফায় তিন বার ধর্না এবং সংসদ চত্বরে পদযাত্রা হয় বিরোধীপক্ষের। বেলা বারোটার সময় রাজ্যসভার ১৫টি বিরোধী দলের প্রায় ৭৫ জন সাংসদ প্ল্যাকার্ড হাতে ( কৃষক বাঁচাও, কর্মী বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও) সারিবদ্ধভাবে গাঁধী মূর্তি থেকে শুরু করে অম্বেডকরের মূর্তি ঘুরে আবার ফিরে আসেন পুরনো জায়গায়। পোস্টার লেখা ছিল বাংলা, হিন্দি-সহ ছটি ভাষায়, এবং প্রত্যেক সংসদীয় নেতা মাতৃভাষায় সংবাদমাধ্যমকে তাঁদের বক্তব্য জানিয়েছেন।
তবে এর পর লোকসভার সদস্যদের ধর্নার চিত্রে সেই ঐক্য দেখা যায়নি। দুপুর দুটোর সময়ে শুধুমাত্র তৃণমূল এবং টিআরএস-কে গাঁধী মূর্তির সামনে ধর্নায় দেখা যায়। আবার বিকেল পাঁচটায় যখন লোকসভার সমস্ত দলের সমাপ্তি-ধর্না করার কথা, সেখানে আবার তৃণমূল (এবং টিআরএস) অনুপস্থিত। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, কৃষক বিল সংক্রান্ত আন্দোলনটি তৃণমূলের উদ্যোগ এবং নেতৃত্বে হওয়ার পর শেষে ফাঁক রয়ে গেল। তৃণমূলের একাংশ এর জন্য কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীর চৌধুরীর ‘একগুঁয়ে মানসিকতাকে’ দায়ী করছেন। তবে আত্মবিশ্লেষণে লোকসভায় নিজেদের কার্যকরী নেতৃত্ব এবং বিরোধীদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষায় ব্যর্থতার দিকটিকেও তুলে ধরছেন।
কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীর চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘রাজ্যসভা তাদের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়েছে, আমরা আমাদের মতো। আমরা তো অন্য দলের জন্য বসে থাকতে পারব না যে তারা কখন আসবে, কখন ধর্নায় দাঁড়াবে! তৃণমূল আগেই ধর্না সেরে নিয়েছে। কে আসবে, কে আসবে না, সেটা সেই দলের ব্যাপার।" রাজনৈতিক সূত্রের মতে, লোকসভায় তৃণমূলের মুখ্য আহ্বায়ক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর মধ্যে যে সমন্বয় হয়নি, এই মন্তব্যে তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।