প্রতীকী চিত্র।
নেট দুনিয়ার খবর, বিনোদনও এ বার সরকারি নজরদারির আওতায়। নিউজ় পোর্টালের খবর হোক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকা খবরের টুকরো (নিউজ় ফিড), তথ্যচিত্র হোক কিংবা নেটফ্লিক্স, অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়ো, হটস্টারের মতো স্ট্রিমিং পরিষেবায় দেখতে পাওয়া সিনেমা, ওয়েব সিরিজ়— যাবতীয় অনলাইন কনটেন্ট (লেখা, অডিয়ো, ভিডিয়ো)-এর উপরে নজরদারির ভার এ বার হাতে তুলে নিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের অনুমোদন পাওয়ার পরে এই বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সরকার।
এই খবর সামনে আসার পরে দিনভর তা নিয়ে চর্চা চলেছে নেট-পাড়ায়। অনেকের মতে, আপাত ভাবে নজরদারির কথা বলা হলেও এটি কার্যত বিনোদন ও খবরে সরকারি শাসন কায়েমের পদক্ষেপ। কোনও স্বশাসিত সংস্থা গড়ে ঘুরপথে সেই কাজটি করা হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা। কারও জিজ্ঞাসা, একাধিক জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ়ে যে গালিগালাজে ঠাসা ভাষায় চরিত্রেরা কথা বলে, তা একই রকম থাকবে কি? সাহসী শয্যাদৃশ্য কিংবা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথার ছড়াছড়ি আর থাকবে কি না, বিস্তর জল্পনা এ সব নিয়েও।
অনেকের চিন্তা খবর নিয়ে। তাঁদের প্রশ্ন, সরকারের ঘরের কোনও দুর্নীতি কিংবা কেলেঙ্কারি আগামী দিনে কতটা নিশ্চিন্তে ফাঁস করতে পারবে কোনও খবরের পোর্টাল? সোশ্যাল মিডিয়ায় কে কোন ধরনের খবর পড়েন এবং পছন্দ করেন, তার উপরেই বা সরকারি নজরদারির সম্ভাবনা কতটা? সরকারি তরফে অবশ্য ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, নজরদারির প্রয়োজন থাকলেও, নিয়ন্ত্রণের বেড়ি পড়ানোর উদ্দেশ্য তাদের নেই।
আরও পডুন: বিজেপি কর্মী হত্যা নিয়ে সরব মোদী
কোনও খবরের কাগজ ভুয়ো খবর, টাকার বিনিময়ে খবর ইত্যাদি ছাপছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার। টেলিভিশনের খবর এবং বিজ্ঞাপনের কনটেন্ট খতিয়ে দেখে যথাক্রমে নিউজ ব্রডকাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং অ্যাডভার্টাজিং স্ট্যান্ডার্ডস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া। প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখাতে ছাড়পত্র প্রয়োজন হয় সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশনের। সেখানে একেবারে নতুন মাধ্যম হওয়ায় অনলাইন কনটেন্টের উপরে নজরদারির কোনও প্রতিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিংবা আইন এ দেশে এখনও নেই। এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে গত বছরই এ ক্ষেত্রে নজরদারির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকড়। কিন্তু তা বলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার কোনও উদ্দেশ্য কেন্দ্রের নেই বলে দাবি করেছিলেন তিনি।
নজরদার কেন্দ্র
নিয়ন্ত্রণে বিস্তার
• এত দিন প্রকাশিত টিভির খবর, সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের গুণাগুণ দেখাশোনার প্রতিষ্ঠান থাকলেও ওয়েব কনটেন্টের জন্য নিয়ন্ত্রক ছিল না। সে দিকেই পা বাড়াল কেন্দ্র।
নতুন নির্দেশ
• ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মে যাবতীয় কনটেন্টে (লেখা, অডিয়ো, ভিডিয়ো) নজরদারি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের আওতায়।
আওতায় কারা?
• অনলাইন নিউজ় পোর্টাল, বিজ্ঞাপন, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়ো, হটস্টারের মতো স্ট্রিমিং পরিষেবা দেওয়া সংস্থা। প্রভাব পড়বে নেটে খবর থেকে শুরু করে ওয়েব সিরিজ়‒ সব কিছুর উপরে।
সমর্থনে যুক্তি
• অনলাইনে ভুয়ো খবরের রমরমা। ওয়েব সিরিজ়েও হিংসা, যৌনতা, গালিগালাজের ছড়াছড়ি। অন্য মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক থাকলেও অনলাইনে ছিল না। তাই তা জরুরি।
বিরুদ্ধে বক্তব্য
• স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। কথা বা দৃশ্যে আপত্তি থাকলে, না-দেখলেই হল। এর পরে সরকার-বিরোধী খবর বা কোনও রাজনৈতিক নেতাকে বিঁধে ওয়েব সিরিজ় তৈরি একই রকম সহজ থাকবে তো?
কেন শুধু অনলাইনে এই নজরদারি গরহাজির, সে বিষয়ে আগে জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, সিনেমায় যার ভগ্নাংশ দেখাতে গেলেও সেন্সর বোর্ডের শংসাপত্র পেতে হোঁচট খেতে হবে, ওয়েব-সিরিজে দিনের পর দিন তা দেখিয়ে যাওয়ার সুযোগ মিলবে কেন? ছাপা কিংবা দেখানো খবরের দায় যদি খবরের কাগজ কিংবা টিভি চ্যানেলকে নিতে হয়, তাহলে নিউজ পোর্টালগুলির এ বিষয়ে ছাড় পাওয়ার কারণ কী? বিশেষ করে বহু ক্ষেত্রেই সোশ্যাল
মিডিয়ায় ‘ভাইরাল হওয়া’ ভুয়ো খবরের কারণে যেখানে হিংসা ও গোষ্ঠী সংঘর্ষ ছড়ানোর বেশ কিছু ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে দেশে। শুধু তা-ই নয়। অনলাইন কনটেন্ট এখন এ দেশে বিপুল এবং বিশাল সম্ভাবনাময় বাজারও। মোবাইলে খবরের শিরোনামে চোখ বুলিয়ে নেওয়া তো আছেই। ২০১৯ সালের মার্চে শুধু স্ট্রিমিং পরিষেবার বাজারই দাঁড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকার। ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। লকডাউন এবং তার পরে এই আধা-ঘরবন্দি জীবনে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত ঊর্ধ্বগামী। ২০২৫ সালে এই বাজারের বপু ফুলেফেঁপে ৪০০০ কোটি টাকার হওয়ার সম্ভাবনা।
সূত্রের খবর, এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাবনাময় বাজারকে একেবারে নজরদারির বাইরে রাখা অযৌক্তিক বলে মনে করেছে কেন্দ্র। আগামী দিনে এর উপযুক্ত আইন তৈরির বন্দোবস্ত হবে। নজরদারির জন্য ভাবা হতে পারে স্বাধীন স্বশাসিত সংস্থা তৈরির কথাও। কিন্তু এই নজরদারির নামে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বেড়ি অনলাইন কনটেন্টের পায়ে চেপে বসবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত নেটিজ়েনদের একাংশ। উদ্বেগে সংশ্লিষ্ট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেও। জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ মির্জ়াপুরের পরিচালক করণ অংশুমানের মতে, এই সেন্সরশিপের কথা মানা যায় না কোনও ভাবেই। আর এক নামী পরিচালকের মতে, “স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়ার বদলে নেট-দুনিয়াকে এ ভাবে বাঁধার চেষ্টা অনেকটা রক্তচোষা ড্রাকুলাকে ব্লাড-ব্যাঙ্কের প্রধান করে দেওয়ার মতো!