নোটের চোট নিয়ে চিন্তায় মোদীর ঘরের লোকই

নোটের চোট অর্থনীতিকে ঘায়েল করবে বলে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন একাধিক নামজাদা অর্থনীতিবিদ। এ বার হুঁশিয়ারি এল খোদ সরকারের ঘর থেকে! বুধবার কেন্দ্রের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন জানালেন, নোট বাতিলের জেরে চলতি আর্থিক বছরের শেষ ছ’মাস (অক্টোবর-মার্চ) বৃদ্ধির হার কী দাঁড়াবে তা যথেষ্ট অনিশ্চিত।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:০৬
Share:

অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন

নোটের চোট অর্থনীতিকে ঘায়েল করবে বলে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন একাধিক নামজাদা অর্থনীতিবিদ। এ বার হুঁশিয়ারি এল খোদ সরকারের ঘর থেকে! বুধবার কেন্দ্রের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন জানালেন, নোট বাতিলের জেরে চলতি আর্থিক বছরের শেষ ছ’মাস (অক্টোবর-মার্চ) বৃদ্ধির হার কী দাঁড়াবে তা যথেষ্ট অনিশ্চিত। সুব্রহ্মণ্যন ছ’মাস অনিশ্চয়তার কথা বললেও তার পরেই অর্থনীতি পুরোপুরি ছন্দে ফিরবে এমন কথা বুক ঠুকে বলতে পারছেন না অনেকেই।

Advertisement

নোট নাকচের সপ্তাহ তিনেক পরেও নগদের যা আকাল, তাতে বিপদের গন্ধ পাচ্ছে শিল্পমহলও। বণিকসভা সিআইআইয়ের প্রেসিডেন্ট নৌশাদ ফোর্বসের মতে, দীর্ঘ মেয়াদে এই পদক্ষেপ দেশের পক্ষে ভাল। কিন্তু যাঁরা নগদে ব্যবসা করেন, তাঁরা জোর ধাক্কা খেয়েছেন। চাহিদা পড়ছে প্রায় সমস্ত পণ্য-পরিষেবারই। শিল্পমহলের একাংশের মতে, তিন সপ্তাহে বাজারে চাহিদা কমেছে অন্তত ৩০ শতাংশ।

নোট বাতিলের বিরুদ্ধে আগেই মুখ খুলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। এ দিন সুর আরও চড়িয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, এই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত আসলে নোট, ব্যাঙ্ক, অর্থনীতির প্রতি মানুষের বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত। সমালোচনার ঝড়ের মুখে ‘একা কুম্ভ’ নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান অরবিন্দ পানাগড়িয়া। তাঁর দাবি, এতে দীর্ঘ মেয়াদে আখেরে লাভই হবে।

Advertisement

সরকারের আর এক ‘ঘরের লোক’ সুব্রহ্মণ্যনের কথায় কিন্তু এই প্রত্যয়ের ছোঁয়া ছিল না। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসু থেকে শুরু করে প্রাক্তন মার্কিন অর্থসচিব ল্যারি সামার্স— নোট বাতিলের সমালোচনা করেছেন অনেকেই। কিন্তু সুব্রহ্মণ্যনের মুখে অনিশ্চয়তার কথা অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিনই দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি (৭.৩%) প্রকাশ করেছে কেন্দ্র। সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই তিনি জানিয়েছেন, প্রথম ছ’মাসের পরিসংখ্যান ভাল। কিন্তু নোট বাতিলের কারণে শেষ ছ’মাস হবে যথেষ্ট অনিশ্চয়তায় মোড়া।

৮ নভেম্বর নোট বাতিলের ঘোষণার পর এই প্রথম মুখ খুললেন সুব্রহ্মণ্যন। বারবার প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা চুপ কেন? অনেকের প্রশ্ন, তবে কি এতে সায় ছিল না তাঁর? যখনই জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁর দফতর থেকে জবাব এসেছে, ‘‘এটি তাঁর বিষয় নয়।’’ আইআইএম-আমদাবাদ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সুব্রহ্মণ্যন দীর্ঘ দিন মার্কিন মুলুকে পড়িয়েছেন। কাজ করেছেন আইএমএফে। তাই তাঁর ডিগ্রি, কাজের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান পদ— কোনওটির সঙ্গেই মন্তব্য করতে না চাওয়ার ওই যুক্তি মেলানো শক্ত। এ দিন মুখ খুলে সরকারের দুশ্চিন্তাই বাড়ালেন সুব্রহ্মণ্যন।

রাজ্যসভায় নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণের দিনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেছিলেন, ‘‘এর পর নোট ও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমতে পারে মানুষের।’’ লেম্যান ব্রাদার্সের পতনের পরে মার্কিন অর্থসচিব হিসেবে মন্দার ধাক্কা সামলানো টিমোথি গেইথনারও বইয়ে লিখেছেন, ‘‘ব্যাঙ্ক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনাস্থাই অর্থনীতির বিপদ ডেকে আনে। সবার আগে সেই বিশ্বাসের ভিত পোক্ত রাখা জরুরি।’’ এ দিন সেই একই যুক্তিতে মোদী সরকারকে বিঁধেছেন অমর্ত্য সেন। তাঁর কথায়, নোটে লেখা থাকে যে, এর বিনিময়ে তাতে যে পরিমাণ টাকার উল্লেখ রয়েছে তা দিতে ব্যাঙ্ক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কার্যত স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত। পুরনো নোটে যত টাকাই ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হোক না কেন, সপ্তাহে নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি তুলতে দেওয়া হচ্ছে না। অমর্ত্যবাবুর এই সমালোচনা সেই পরিপ্রেক্ষিতেই।

অর্থনীতির প্রথম পাঠ বলে, মানুষ চুটিয়ে জিনিসপত্র কেনেন তখনই, যখন হাতে টাকা থাকে। সেই সঙ্গে থাকে আগামী দিনেও তা হাতে থাকার নিশ্চয়তা। এখন ঘাটতি দু’টিতেই। ব্যাঙ্কে টাকা আছে। বাজারে জিনিসও রয়েছে। অথচ যথেষ্ট টাকা তুলতে না পারায় চাহিদা বাড়ন্ত। টাকার অভাবে মাল তুলতে সমস্যায় পড়ছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। কঠিন হচ্ছে নগদে বেতন দেওয়া। সমস্যায় ছোট শিল্পও। কাজ হারাচ্ছেন সেখানকার বহু কর্মী।

শিল্পের চাকা যে ক্রমশ এই দুষ্ট চক্রে আটকে যাচ্ছে, তা বুঝেই এ দিন ফোর্বসের দাওয়াই, দ্রুত নগদের জোগান বাড়াক কেন্দ্র। বিশেষত পাঁচশোর নোটের। কিন্তু সেটি কী ভাবে হবে, তা জানা নেই বলেই কি ‘এখন ছ’মাস অনিশ্চয়তায় মোড়া?’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement