বজ্রগর্ভ: কালো মেঘে ছেয়েছে আকাশ, শুরু বজ্রপাতও। সোমবার বিকেলে, দমদমে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
রাজনৈতিক বা সামাজিক হিংসা নয়, অভিবাসনের (মাইগ্রেশন) ক্ষেত্রে মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন। বর্তমানে অভিবাসনের নেপথ্যের মূল কারণও জলবায়ু পরিবর্তন। তবে তার সঙ্গে ভবিষ্যতের অভিবাসনের একটা ফারাক থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
তাঁদের বক্তব্য, বর্তমানে অভিবাসনের ধরন মূলত অস্থায়ী। যেমন কোনও ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরার সময়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ অন্যত্র চলে যান বা সরকার তাঁদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায়। আবার বিপর্যয় মিটলে তাঁরা
পূর্বের জায়গায় ফিরে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে গত বছরের আমপান এবং চলতি বছরের ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যে ভাবে ঘূর্ণিঝড়-সহ জলবায়ুগত বিপর্যয়ের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, তাতে জনসংখ্যার একটা অংশ পাকাপাকি ভাবে ঘর ছাড়া হতে পারে। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর একটি ছোট অংশ, যারা অন্যত্র জীবিকা নির্বাহে সক্ষম, তারা অন্য জায়গায় থাকা শুরু করেছে। ভবিষ্যতে সেই সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই অনুমান বিশেষজ্ঞদের।
‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইকনমিক্স’-এর ফেলো সৌদামিনী দাস বলছেন, ‘‘জলবায়ুগত বিপর্যয়প্রবণ অঞ্চলগুলিতে সরকার জীবিকা বা বাসস্থানের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা অংশ পাকাপাকি ভাবে ঘরছাড়া হতে পারে।’’ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের গঠিত ‘দ্য ওয়ার্কিং গ্রুপ অন মাইগ্রেশন, ২০১৭’-এর সদস্য, অধ্যাপক এস চন্দ্রশেখর বলছেন, ‘‘অভিবাসন যে সব সময়েই ভাল কাজের নিশ্চয়তা দেয়, এমন নয়। অভিবাসীদের সিংহভাগই নির্মাণশিল্পের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।’’ কিন্তু জীবিকার অনিশ্চয়তা রয়েছে জেনেও কেন একটা অংশ অভিবাসী হচ্ছেন? ‘‘কারণ, তাঁরা জানেন, ওই এলাকায় কোনও দিনই তাঁদের স্থায়ী সম্পত্তি হবে না। তাই তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ শহুরে এলাকার আশপাশে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেছে। এই প্রবণতা আয়লার পর থেকে সুন্দরবনে যেমন শুরু হয়েছে, তেমনই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।’’— বলছেন নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেস’-এর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক অপরাজিতা চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়প্রবণ এলাকার সব পরিবারের পক্ষেই নিকট ভবিষ্যতে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, অত চাকরি বা বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ কোথায়? তা ছাড়া, ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়াটা অত সহজ নয়। তাঁর কথায়, ‘‘তবে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে আর্থিক ভাবে দুর্বল পরিবারের এক জন-দু’জন সদস্য কাজের সূত্রে শহুরে এলাকা বা অন্য রাজ্যে মাইগ্রেট করছেন। অপেক্ষাকৃত ভাল ও সুস্থিত রোজগার বা পরিবারকে অর্থ সাহায্য করাই এর কারণ।’’
‘ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার’-এর তথ্য জানাচ্ছে, বিশ্বের মধ্যে অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতির ঘটনার নিরিখে ভারত রয়েছে প্রথম সারিতে। অপরাধমূলক এবং রাজনৈতিক হিংসার জন্য যত মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন, তাঁর থেকে অনেক বেশি মানুষ ঘর ছেড়েছেন জলবায়ুগত বিপর্যয়ের কারণে। পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর ডিরেক্টর জেনারেল সুনীতা নারায়ণ বলছেন, ‘‘২০০৮-’২০ সালের মধ্যে ভারতে বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ও খরার কারণে প্রতি বছর প্রায় ৩৭.৩ লক্ষ মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছেন। শুধু ভারতই নয়, সারা বিশ্বে ২০২০ সালে যত অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি হয়েছে, তার ৭৬ শতাংশের নেপথ্যেই রয়েছে জলবায়ুগত বিপর্যয়।’’