আট ঘাট বেঁধে কাজ, জানতেন না মন্ত্রীরাও

সাউথ ব্লকে সাধারণত মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটায়। মনমোহন সিংহের আমল থেকেই এই ট্র্যাডিশন চলেছে। নরেন্দ্র মোদী এই রুটিনে কোনও পরিবর্তন আনেননি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৫০
Share:

সাউথ ব্লকে সাধারণত মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটায়। মনমোহন সিংহের আমল থেকেই এই ট্র্যাডিশন চলেছে। নরেন্দ্র মোদী এই রুটিনে কোনও পরিবর্তন আনেননি। কিন্তু গত কাল, মঙ্গলবার, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ক্যাবিনেট সচিবের কাছ থেকে একটি আচমকা ফোন পান ক্রীড়ামন্ত্রী বিজয় গয়াল। জানানো হয়, ‘সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী। চলে আসুন প্লিজ!’

Advertisement

বিজয় আজ বলেন, ‘‘তখনও কি জানতাম যে প্রধানমন্ত্রী এমন একটি অ্যাটম বোমা ফাটাতে চলেছেন!’’ শুধু ক্রীড়ামন্ত্রী নন, মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন অন্ধকারে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার আগে গত কাল লালকৃষ্ণ আডবাণীর জন্মদিন উপলক্ষে বেশ কিছু মন্ত্রী এসেছিলেন তাঁর বাসভবনে। প্রকাশ জাভড়েকর, পীযূষ গয়াল সেখান থেকে যখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিতে দৌড়চ্ছেন, তখনও তাঁরা জানেন না কিছু ক্ষণের মধ্যে কী ঘটতে চলেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী এক মন্ত্রী জানাচ্ছেন, বৈঠকে মোদী যখন বোমাটি ফাটান, অধিকাংশ মন্ত্রীর মুখই তখন সাদা হয়ে যায়। আজকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকেও মন্ত্রীদের মোবাইল জমা রেখে ঢুকতে হয়। সূত্র খবর, গত কাল প্রধানমন্ত্রী নিজেই সকলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন— জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর ঘোষণার আগে কোনও মন্ত্রী যেন বাইরে নোট বাতিলেরপ কথা ফাঁস না করেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী বিজয় গয়ালকে বলেন, ‘‘আজ রাতেই দিল্লির বণিক সংগঠনের নেতাদের বোঝান, দেশের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা জরুরি ছিল। তাঁদের বলুন বিবৃতি দিয়ে আজই এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাতে।’’ বণিক সম্প্রদায়ের নেতা বিজয় গয়ালের তখন অসহায় অবস্থা।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র বলছে, গত ছ’মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী এই মোক্ষম চালটি চালার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। প্রথমে, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া জানতেন শুধু তিন জন। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রধান দীনেশ্বর শর্মা। পরে বিষয়টি জানানো হয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন গর্ভনর উর্জিত পটেলকে। কালো টাকা রুখতে ৫০০ ও হাজার টাকার নোট বাতিলের এই প্রস্তাব অবশ্য তত্ত্বগত ভাবে একেবারে নতুন নয়। যোগগুরু রামদেব এক প্রশ্নের জবাবে আজ দাবি করেছেন, ‘‘আমি অনেক দিন আগেই এই প্রস্তাবটি দিয়েছিলাম। আমি খুব খুশি যে এই কাজটি নরেন্দ্র মোদী করে দেখালেন। অবশ্যই মাস্টার স্ট্রোক!’’

তবে শুধু রামদেব নন, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতও ভোটের আগে থেকেই মোদীর কাছে কালো টাকা রুখতে একাধিক প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে সব বাস্তবায়িত করার জন্য চাপ ছিল মোদী সরকারের উপরে। পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে নির্বাচনের আগেই এই অভিযান কার্যকর করার একটা চাপ এসেছিল। কিন্তু মোদী তখন তাতে সাড়া দেননি। এখন তিনি নাটকীয় ভাবে এই ঘোষণা করলেন। কেন?

বিজেপি সূত্র বলছে, মোদী অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে নোট বাতিলের ঘোষণার জন্য এই সময়টি বেছেছেন। হিসেব কষা ঝুঁকি নিয়ে নিজের রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিস্থিতিকে উল্টে দিতে চেয়েছেন। কালো টাকা ও দুর্নীতি দমনের মসিহা হতে চেয়েছেন। আর সেটা করেছেন আট ঘাট বেঁধেই। প্রথমত, গোটা দেশে এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে গোয়েন্দা প্রধানের কাছে রিপোর্ট নিয়ে তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয়ত, কোন কোন মুখ্যমন্ত্রী বিরোধিতা করতে পারেন, বিরোধীরা কী অবস্থান নিতে পারেন, এমনকী দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখেছেন। তৃতীয়ত, নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ছাপানোর আগাম ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। পাশাপাশি, ব্যাঙ্কগুলির এটিএমে ১০০ টাকা জোগানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নতুন করে ১০০ টাকা ছাপানোর ব্যবস্থাও হয়েছে। এবং পুরোটা হয়েছে একেবারে নিঃশব্দে।

বিরোধীরা অবশ্য অভিযোগ করছেন যে, আরও অনেক কিছু নিঃশব্দে করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে নির্বাচনে নগদ টাকা ব্যবহারের পরম্পরা বহু দিনের। এ বার মায়াবতী ভোটে সব চেয়ে বেশি খরচ করার জন্য প্রস্তুত। তার পর রয়েছেন সমাজবাদী পার্টি। এই আচমকা সিদ্ধান্তে সব চেয়ে বিপদে পড়ে গিয়েছেন মায়াবতী-মুলায়ম, এমনটাই বলছেন বিজেপি নেতারা।

আর বিজেপি-বিরোধী শিবির বলছে, ‘‘আগাম খবর থাকায় ওরা ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট অনেক আগেই জেলায় জেলায় বণ্টন করে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সে টাকা দিয়ে সোনাও কিনে নেওয়া হয়েছে। মূল অপারেশন গোপন রেখেও সংগঠনের রাজ্যস্তরে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে বড় নোট ব্যবহার না-করা। উত্তরপ্রদেশের ভোটকে মাথায় রেখে এ এক মোক্ষম চাল যাতে বিজেপি-বিরোধী শিবির অসুবিধায় পড়ে।’’ বিজেপি মুখপাত্র শ্রীকান্ত শর্মা অবশ্য বলেন, ‘‘এ সবই অপপ্রচার। জাল নোট তৈরির পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র আর কালো টাকার দুর্নীতি রুখতে সরকারের এই মহান কাজটিকে খাটো করতে প্রতিপক্ষ এই অপপ্রচার চালাচ্ছে।’’

হতে পারে এ’টি পূর্ব-পরিকল্পিত মোক্ষম চাল, কিন্তু প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের মন্তব্য, ‘‘অনেক সময়ই অতি চালাকের কী পরিণতি হয় তা আমরা জানি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement