সুনীল মণ্ডল ও শিশির অধিকারী ফাইল চিত্র।
দলত্যাগ বিরোধী আইনে তৃণমূল সাংসদ সুনীল মণ্ডল ও শিশির অধিকারীর সাংসদ পদ খারিজ করার জন্য লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে অনুরোধ করেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। প্রায় বছর কেটে যাওয়ার মুখে লোকসভার স্পিকার আজ জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। শীতকালীন অধিবেশনের আগে সাংবাদিক বৈঠকে স্পিকার বলেন, ‘‘এই সংক্রান্ত প্রক্রিয়া চলছে। উপযুক্ত সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’ স্পিকারের সচিবালয়ের একটি সূত্র অবশ্য জানাচ্ছে, সুনীল মণ্ডল তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ফের তৃণমূলে ফিরে এসেছেন। তাই তাঁর সদস্য পদ খারিজের আর্জি নিয়ে তৃণমূল আর এগোতে চায় না বলে ঘরোয়া ভাবে বার্তা দিয়েছে।
আগামী ১৬ থেকে ১৯ নভেম্বর শিমলাতে স্পিকারদের সম্মেলন হওয়ার কথা। দলবদলু সাংসদ বিধায়কদের বিষয়ে সিদ্ধা্ন্ত নিতে দীর্ঘসূত্রিতার একাধিক অভিযোগ ওঠায় স্পিকারদের ক্ষমতা বেধে দেওয়ার দাবি উঠেছে অনেকদিন ধরেই। স্পিকারদের ক্ষমতা বেধে দেওয়া উচিত কিনা, তা খতিয়ে দেখতে দু’বছর আগে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পিসি জোশীর নেতৃত্বাধীন কমিটিকে। ওম বিড়লা আজ বলেন, ‘‘আমাদের কাছে জোশী কমিটির রিপোর্ট জমা পড়েছে, শিমলায় আলোচনায় হবে।’’
প্রশ্ন উঠেছে, কেন এই দেরি? কেন দলত্যাগ করার নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে বিধায়ক বা সাংসদকে পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হবে না। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক শিবিরকে সুবিধা করে দিতেই এই দীর্ঘসূত্রিতা। লোকসভা হোক বা বিধানসভা। সর্বত্রই এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, দলবদলু নেতাদের সাংসদ বা বিধায়ক পদ খারিজের আর্জি জমা পড়ে। কিন্তু লোকসভা বা বিধানসভার স্পিকার বছরের পর বছর সিদ্ধান্ত না নিয়ে বসে থাকেন কেবল শাসক শিবিরকে ফায়দা করে দিতে। ফলে প্রশ্ন ওঠে স্পিকার পদের নিরপেক্ষতা নিয়েও।
পশ্চিমবঙ্গে গত দু’টি বিধানসভাতেই কংগ্রেস ও সিপিএমের টিকিটে জিতে এসে তৃণমূলে যোগ দেওয়া একাধিক বিধায়কের সদস্যপদ খারিজের জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন জমা পড়েছিল। স্পিকারের সামনে একাধিক বার শুনানিও হয়। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই চলে আসে বিধানসভা নির্বাচন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে মুকুল রায় বিজেপির টিকিটে জিতে এসে তৃণমূলে যোগ দেন। তাঁর সদস্যপদ খারিজের জন্য স্পিকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে বিজেপি। কিন্তু নিষ্পত্তি হয়নি। অভিযোগের আঙুল উঠেছে তৃণমূলের দিকে। একই চিত্র সংসদে। কেবল দল ভিন্ন। বিধানসভা ভোটের আগে, গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বিজেপিতে যোগ দেন তৃণমূল সাংসদ সুনীল মণ্ডল। সুনীলের সাংসদ পদ খারিজের জন্য জানুয়ারি মাসে স্পিকারের কাছে আবেদন জানান তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সে সময়েই ছেলে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি যান বাবা শিশির অধিকারীও। বিজেপির প্রচার মঞ্চে দেখা যায় শিশিরবাবুকে। তাই সুনীলের মতো শিশিরেরও সংসদ পদ খারিজ করার আবেদন জানিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু বছর শেষেও সেই অভিযোগের ফয়সালা হয়নি। এ ক্ষেত্রে বিরোধীদের নিশানায় বিজেপি। অভিযোগ, শাসক শিবিরের অঙ্গুলিহেলনেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি স্পিকার।
তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাতে দলবদলু বিধায়ক-সাংসদদের পদ খারিজ হয়ে যায়— সে জন্য দীর্ঘ দিন ধরেই দাবি উঠেছে। সংবিধানের দশম তফশিল অনুযায়ী, স্পিকারের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেধে দিতে সংসদই আইন তৈরি করতে পারে বলে ২০১৯ সালে কনার্টকের দলত্যাগী বিধায়কদের সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়ার মামলায় বলেছিলেন বিচারপতি এন ভি রমণা। তিনি এ-ও বলেছিলেন, স্পিকারদের মধ্যে দলীয় রাজনীতিতে আটকে গিয়ে নিরপেক্ষ ভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত সংসদের। এ নিয়ে আইন তৈরির প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন জমা পড়ে। প্রাথমিক ভাবে আবেদন শুনে আইন তৈরি সংসদের বিষয় বলে শাসক শিবিরের কোর্টে বল ঠেলে দেন বিচারপতি রমণা। কিন্তু তার পরে বিষয়টি আর এগোয়নি।
আজ স্পিকার দাবি করেছেন, তিনি আশাবাদী চলতি সপ্তাহে শিমলার বৈঠকে দলবদলু সাংসদ-বিধায়কদের সদস্য পদ খারিজের প্রশ্নে একটি সমাধান সূত্র পাওয়া সম্ভব হবে। সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘দলবদল নিয়ে দিল্লিতে সরব হলেও বাংলায় নীরব তৃণমূল। একই ভাবে নিজেদের সুবিধামতো অবস্থান নিচ্ছে বিজেপিও।’’ তাঁর মতে, দলবদল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে স্পষ্ট সময়সীমা ঠিক করে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।