বাক্স-বদল! বই-খাতায় প্রথা ভাঙলেন নির্মলা

সেই ব্রিটিশ যুগ হয়ে জওহরলাল নেহরুর সময় থেকে চলে আসা ‘ট্র্যাডিশন’ ভাঙলেন দেশের প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯ ০১:৩০
Share:

এখন-তখন: লাল কাপড়ের ‘বই-খাতা’ হাতে সংসদে ঢুকছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। প্রথামাফিক সব আমলে অর্থমন্ত্রীরা ব্রিফকেস হাতে বাজেট পড়তে আসতেন। একে ঔপনিবেশিক রীতি বলে মনে করা হয়। ২০১৮ সালে এ ভাবেই এসেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ছবি: পিটিআই।

মনমোহন সিংহ আসতেন কালো অ্যাটাচি কেস নিয়ে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে থাকত খাঁটি বিলিতি ‘গ্ল্যাডস্টোন’ ধাঁচের ব্রিফকেস। পি চিদম্বরম, অরুণ জেটলির হাতেও তা-ই।

Advertisement

সেই ব্রিটিশ যুগ হয়ে জওহরলাল নেহরুর সময় থেকে চলে আসা ‘ট্র্যাডিশন’ ভাঙলেন দেশের প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী। নির্মলা সীতারামন বুঝিয়ে দিলেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশকতার ‘বাক্সে’ আটকে থাকতে চান না তিনি। বরং তিনি আস্থা রাখছেন সনাতন ভারতীয় ‘বই-খাতা’য়। খেরোর খাতার মতো দড়ি-বাঁধা একটি লাল ব্যাগ (যার উপরে সোনালি অশোক স্তম্ভ জ্বলজ্বল করছে) হাতে সাউথ ব্লক থেকে আজ সকালে সংসদে এসে পৌঁছন নির্মলা। ওই লাল মোড়কের ভিতরেই ছিল বাজেটের কাগজ।

গোটা দিনই রাজধানী সরগরম রইল নির্মলার এই প্রথা-ভাঙা বাজেট-বিপ্লবে! বিপ্লব কেন? ‘বাজেট’ শব্দটির উৎপত্তির নেপথ্যেই তো রয়েছে চামড়ার বাক্স! ফরাসি ‘বুজেত’ শব্দটির অর্থ চামড়ার বাক্স, এবং সেখান থেকেই ‘বাজেট’! নির্মলার কথায়, ‘‘কেন আমাকে চামড়ার ব্রিফকেসই ব্যবহার করতে হবে বাজেটের কাগজ রাখার জন্য? অনেক হয়েছে। এ বার সময় এসে গিয়েছে ব্রিটিশ প্রথা থেকে বেরিয়ে আসার! নিজেদের কিছু করা প্রয়োজন। এটা বইতেও আমার সুবিধে হচ্ছে।’’

Advertisement

উনবিংশ শতক থেকে ‘বাজেট কেস’ ঐতিহ্যের সূত্রপাত। ব্রিটিশ রাজস্ব বিভাগের চ্যান্সেলর উইলিয়াম ই গ্ল্যাডস্টোন (পরে যিনি প্রধানমন্ত্রীও হন) তাঁর বাজেটের কাগজ নিতেন লাল চামড়ার কেস-এ, যার উপরে থাকত রানির মনোগ্রাম, সোনালি রঙে। পরবর্তী সময়েও ব্রিটিশ রাজের বিভিন্ন মন্ত্রী একই কেস ব্যবহার করে এসেছেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৫৮-৫৯ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করেছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজেই। তিনি এসেছিলেন কালো রঙের ব্রিফকেস নিয়ে। ব্রিফকেসই চলে আসছিল ধারাবাহিক ভাবে।

অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের সময়ে বাজেট সংক্রান্ত আরও একটি ঔপনিবেশিক প্রথার অবসান ঘটেছিল। ২০০১ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্‌হা ব্রিটিশ ঐতিহ্যের অবসান ঘটিয়ে বিকেল পাঁচটার বদলে সকাল এগারোটায় বাজেট বক্তৃতা চালু করেন। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ আমলা ব্যাসিল ব্ল্যাকেট শুরু করেছিলেন সান্ধ্যকালীন বাজেট বক্তৃতা, যা স্বাধীনতার পরেও বহাল ছিল।

নির্মলার আজকের এই প্রথা-ভাঙা পদক্ষেপ নিয়ে অবশ্য টিপ্পনী কেটেছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। পি চিদম্বরমের কথায়, ‘‘ভবিষ্যতে অর্থমন্ত্রী আইপ্যাড নিয়ে আসবেন!’’ লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘এই সরকার শুধুমাত্র চমক দেখানোয় বিশ্বাসী। নিজেদের বিপণন করার চেষ্টায় ব্যস্ত। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।’’ তৃণমূলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথায়, ‘‘কিসের মধ্যে করে বাজেট এনেছেন, সেটা বড় কথা নয়। বাজেট যে হতাশাজনক, সেটাই সব কিছু ছাপিয়ে উঠে আসছে।’’

প্রথা-ভাঙায় বিরোধীদের সমর্থন না-মিললেও নির্মলা আজ তামিল কবি পিসিরানদাইয়ার-এর কবিতা যখন উদ্ধৃত করেছেন, তখন টেবিল চাপড়ে হর্ষ প্রকাশ করেছেন ডিএমকে-র সাংসদেরা! যে কবিতার মর্মার্থ, পরিমিত খাবারেই একটি হাতির খাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু সে নিজে জমিতে ঢুকে খেতে গেলে, নষ্ট হয় অনেক বেশি। গ্যালারিতে বসেছিলেন নির্মলার মামা-মামি এবং কন্যা ভাঙ্গামাইয়া পরকলা। প্রিয় কবির এই কবিতা শুনে উত্তেজিত দেখায় তাঁদেরও। যদিও এই সময়ে বিরোধী শিবিরের কয়েক জন সাংসদকে মৃদু আপত্তি তুলতেও দেখা যায়। আসলে অনেকেই ভেবেছিলেন, সরকারকে ওই হাতির সঙ্গে তুলনা করছেন অর্থমন্ত্রী। ইঙ্গিত দিচ্ছেন, প্রাপ্য কর না-পেলে তোলপাড় শুরু করবে সরকার। বাজেটের পরে দূরদর্শনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই ধোঁয়াশা স্পষ্ট করতে হয়েছে নির্মলাকে। তাঁকে বোঝাতে হয়েছে, কেন্দ্র কারও পরিসরে ঢুকবে না। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘করদাতারা যা দেবেন, তাতেই সরকার সন্তুষ্ট থাকবে। আমি বলতে চেয়েছিলাম, সরকার ওই প্রবাদের হাতির মতো খেতে ঢুকে ফসল নষ্ট করবে না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement