শিব-পার্বতীর বিয়ের প্রস্তুতি। নিজস্ব চিত্র
কাপড় দিয়ে পুতুল তৈরি করে শিব-পার্বতীর বিয়ে। তাই বলে খেলাঘরের পুতুলের বিয়ে নয়। নতুন বছরকে আবাহন জানাতে বিয়ের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানই পালন করেন কাছাড়ের কোচ রাজবংশীরা। আনন্দ-স্ফূর্তির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস। তাই পুতুল বিয়েতেও গোটা গ্রাম জড়িয়ে পড়ে। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, সকলের কাছে তাই চৈত্র সংক্রান্তি এক পবিত্র দিন। সে দিনই তাঁরা শিব-পার্বতীর বিয়ে দিয়ে তাঁদের কাছে তিন বর প্রার্থনা করেন। নতুন বছরে যেন খুব ভাল ফসল হয়, প্রতিটি মানুষ যেন সারা বছর সুস্থ থাকেন এবং গ্রামের মানুষের সার্বিক মঙ্গল কামনা করেন তাঁরা।
জগন্নাথ সিংহ কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক স্বপন দাসের গবেষণা গ্রন্থে রয়েছে, কাছাড়ের নয়টি গ্রামে কোচ রাজবংশীরা বসবাস করেন৷ কোচ দেওয়ান চিলারায় নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে কাছাড় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিলেন। যুদ্ধ জয় করে ফিরে যাওয়ার সময়ে সৈনিকদের একাংশ এখানে থেকে যান৷ তাঁদের বংশধরদেরই প্রায় এক হাজার পরিবার এখানে বসবাস করে। দেওয়ানের বংশধর বলে আগে তাঁদের দেওয়ানি বলা হতো৷ এখনও কেউ কেউ কোচদের দেওয়ানি বা ধেয়ানি বলেন৷ তবে বর্তমানে তাঁরা রাজবংশী হিসেবেই বেশি পরিচিত৷
লোক-সংস্কৃতির গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য জানান, কোচ রাজবংশীরা ষোড়শ শতকে এখানে আসেন৷ সঙ্গে নিয়ে আসেন নিজস্ব সংস্কৃতি-পরম্পরা৷ কোচবিহার বা অসমের অন্যান্য অঞ্চলে কোচ সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটলেও কাছাড়ের রাজবংশীরা নিজেদের পরম্পরা ধরে রেখেছেন৷ তাই অন্য কোনও এলাকায় কোচদের শিব-পার্বতীর বিয়ের আয়োজন না হলেও তাঁর বিশ্বাস, এটি বহু প্রাচীন কোচ পরম্পরা, সম্ভবত অন্যত্র তা হারিয়ে গিয়েছে৷ লারসিংপারের উমানন্দ রাজবংশী, হরিনগরের রাজবংশী দম্পতি ডুলেট রাজবংশী ও রাজনী বাজবংশী জানান, মূলত অবিবাহিত তরুণীরাই এই পার্বণের উদ্যোক্তা৷ ১৪-১৫ পরিবার মিলে এক একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়৷ তরুণীরাই বসে স্থির করেন, কোন বাড়িতে বর থাকবেন, কোন বাড়িতে কনে৷ কত খরচ হবে, কারা কত চাঁদা দেবে, এই বাজেটটাও তাঁরা তৈরি করেন৷
অধিবাস, বরযাত্রী নিয়ে বরের আগমণ, সাত পাক, মালাবদল সবই হয় কোচ রাজবংশীদের বিয়ের মতো৷ শুধু ফারাক, বর গাড়ি চড়ে যান না৷ শিবঠাকুর বলে কথা, তিনি সুসজ্জিত পাল্কিতে চেপে কনের বাড়ি আসেন৷ বিয়ে সেরে রাতেই কনেকে নিয়ে রওনা হন৷ তবে কৈলাসে পৌঁছনোর জন্য তাঁদের নদীতে নিয়ে ছাড়া হয়৷
শিব-পার্বতীর বিয়ে ঘিরে বর্ষবরণের প্রাক্সন্ধ্যা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে কাছাড়ের প্রতিটি রাজবংশী গ্রাম৷