সারদার মতো ভুয়ো অর্থলগ্নি সংস্থাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে এ বার নতুন আইন আসছে।
যে আইনে রাজ্য সরকার এই ধরনের সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা জেলাশাসকদের হাতেই তুলে দিতে পারবে। জেলাশাসক যদি নিশ্চিত হন যে সংস্থাটি আইন ভেঙে, সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা তুলছে, তা হলে তিনি সংস্থাটির সম্পত্তি বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্তও করতে পারবেন।
সারদা-কাণ্ডে দেখা গিয়েছিল, সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার আগে বা সারদার কাজকর্ম বন্ধ করার আগেই গরিব মানুষকে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা তুলে ফেলেছিলেন। সেই টাকা তার পরে কোথায়, কার সিন্দুকে ঢুকেছে, সিবিআই এখনও তার পুরোপুরি হদিস পায়নি। এর পুনরাবৃত্তি রুখতে নতুন আইনে একেবারে গোড়াতেই কোপ মারার বন্দোবস্ত থাকছে। বেআইনি সংস্থার এজেন্টরা চড়া সুদের লোভ দেখিয়ে টাকা তোলার জন্য প্রচার শুরু করলেই শাস্তির আওতায় চলে আসবেন। টাকা নিয়ে শোধ দিতে না পারলে আরও কড়া শাস্তির বন্দোবস্ত থাকছে।
ফেব্রুয়ারিতে বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ঘোষণা করেছিলেন, বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার দৌরাত্ম্য রুখতে চলতি অর্থ বছরেই নতুন আইন তৈরি হবে। এখন বিভিন্ন ধরনের অর্থলগ্নি প্রকল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন রকম আইন রয়েছে। লগ্নির রকমফের অনুযায়ী কোনওটির দায়িত্বে রাজ্য সরকার, কোনওটির আবার সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা কর্পোরেট মন্ত্রক। পশ্চিমবঙ্গের মতো অনেক রাজ্যের আবার নিজস্ব আইনও রয়েছে। জেটলির মতে, এরই সুযোগ নিয়ে থাকেন সুদীপ্ত সেনের মতো ব্যক্তিরা। এক গুচ্ছ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইনের ফাঁক গলে তারা কাজ চালিয়ে যায়। যত দিনে সেবি, রাজ্য পুলিশ বা সিবিআই তদন্তে নামছে, তত দিনে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সর্বস্বান্ত করে তাদের বহু কষ্টের সঞ্চয়ের টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়। সারদা-সহ পূর্ব ভারতের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে এখনও পর্যন্ত সিবিআইয়ের হিসেব, ৬ কোটির বেশি মানুষের থেকে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা তোলা হয়েছে। সবটাই বেআইনি ভাবে। এর মোকাবিলা করতেই একটি সার্বিক আইন তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
‘বেআইনি লগ্নিপ্রকল্প নিষেধাজ্ঞা ও আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা বিল’-এর কাজ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। অর্থ মন্ত্রক আইনের খসড়া তৈরির পরে আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠীতেও আলোচনা হয়ে গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতামত নেওয়ার কাজও শেষ। খসড়া চূড়ান্ত করে এ বার মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
কী রয়েছে এই প্রস্তাবিত আইনে?
অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা জানিয়েছেন, কারাদণ্ড, অর্থ সংগ্রহের দুই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানার বন্দোবস্ত তো থাকছেই। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, রাজ্য চাইলে বেআইনি লগ্নি সংস্থাগুলির উপর নজরদারি চালাতে জেলাশাসকদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দিতে পারবে। কারণ সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা অন্য কোনও সরকারি সংস্থার থেকে জেলা প্রশাসনের কাছেই এ সব খবর আগে পৌঁছয়। কেন্দ্রের প্রস্তাব হল, গোটা রাজ্যের দায়িত্বে এক জন অন্তত জেলাশাসক পদমর্যাদার অফিসার থাকবেন। কোনও সংস্থা বেআইনি ভাবে টাকা তুলছে মনে করলে জেলাশাসকই তাদের নথি, হিসেবের খাতা পরীক্ষা করা ও তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ সুপারের অনুমোদন নিয়ে পুলিশ সংস্থাটির দফতরে ঢুকে তল্লাশি বা নথি আটক করতে পারে। সংস্থার কর্তাদের আটক করার ক্ষমতাও দেওয়া হবে পুলিশকে। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে জেলাশাসকই প্রাথমিক ভাবে সংস্থার সম্পত্তি, প্রয়োজনে সংস্থার মালিক ও কর্তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। এ জন্য নির্দিষ্ট আদালত তৈরি হবে। সেখানেই এর চূড়ান্ত ফয়সালা হবে।
প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, কোনও জেলায় বেআইনি ভাবে টাকা তোলা শুরু হলে, সেখানকার জেলাশাসক ব্যবসা বন্ধের নির্দেশ দিতে পারবেন। সংস্থার অফিস অন্য জেলায় হলে, সেখানকার জেলাশাসক বা রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার সেখানে ব্যবস্থা নেবেন। যে সব রাজ্যে এই ধরনের ভুয়ো লগ্নি সংস্থার দৌরাত্ম্য কম, সেখানে রাজ্য সরকার মনে করলে এক জন জেলাশাসক বা আরও উচ্চ পদের কোনও অফিসারকে গোটা রাজ্যের দায়িত্ব দিতে পারবে। যেখানে দৌরাত্ম্য বেশি, সেখানে সব জেলাশাসককেই ক্ষমতা দেওয়া যাবে। সাধারণ মানুষের থেকে টাকা সংগ্রহ করলে, তা সে আইনি পথে হলেও, ওই অফিসারদের আগাম জানাতে হবে। যে কোনও ক্ষেত্রেই আইন ভাঙলে তা ফৌজদারি অপরাধের তালিকায় পড়বে।
সারদার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা হওয়ার পর সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, সাধারণ ভাবে রাজ্যগুলি নিজে থেকে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে অনীহা দেখায়।
আর রাজ্য পুলিশের পক্ষেও একাধিক রাজ্যে জাল ছড়িয়ে ফেলা বেআইনি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ঠিকমতো তদন্ত করা সম্ভব হয় না। এই সমস্যার সমাধানে নতুন প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রকের আর্থিক পরিষেবা দফতরের সচিবের নেতৃত্বে একটি এমপাওয়ার্ড কমিটি তৈরি হবে। স্বরাষ্ট্র, কর্পোরেট, আইন মন্ত্রকের সচিব, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর, সেবি-র চেয়ারম্যান ও সিবিআইয়ের অধিকর্তা ওই কমিটিতে থাকবেন। কমিটি মনে করলে কোনও সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবে। অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘আইনে যাবতীয় ফাঁকফোকর বুজিয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তবে আইন কতখানি কার্যকর হবে, তার পুরোটাই নির্ভর করবে রাজ্য প্রশাসনের উপর।’’