দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন মোড়। ছবি- পিটিআই।
কাশ্মীর প্রসঙ্গ উঠলই না। মমল্লপুরমের সমুদ্রসৈকতের কাছে একটি রিসর্টে ভারত ও চিনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি নতুন যুগ শুরু হল। দুই প্রতিবেশী দেশ সিদ্ধান্ত নিল, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ দমনে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বে। আর বাণিজ্য, যোগাযোগ, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও জোরাদার করে তুলবে ভারত ও চিন।
চেন্নাই থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে মমল্লপুরমের সমুদ্রসৈকতের কাছে একটি রিসর্টে শুক্র ও শনিবারের দু’দফার বৈঠকের পর দৃশ্যতই খুশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, ‘‘উহানের শীর্ষ সম্মেলন ভারত ও চিনের পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্পর্ককে জোরদার করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। আর চেন্নাইয়ের এই বৈঠকে (‘চেন্নাই কানেক্ট’) দু’দেশই পারস্পরিক সম্পর্কে একটি নতুন যুগ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’ চিনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর দু’দেশের প্রতিনিধিদদলের বৈঠকে এ কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে একই কথা জানিয়েছেন বিদেশসচিব বিজয় গোখলে।
শুক্রবার রাতের বৈঠক সম্পর্কে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং মোদীর সুরে সুর মিলিয়েই বলেছেন, ‘‘গত কাল প্রধানমন্ত্রীর (নরেন্দ্র মোদী) সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো কথা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে কথা হয়েছে খুবই আন্তরিক ভাবে। নতুন যুগ শুরু হল দু’দেশের সম্পর্কে।’’ এ দিন বিদেশসচিব গোখলে বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে বৈঠক সেরে নেপাল রওনা হওয়ার আগে চিনা প্রেসিডেন্ট জানিয়ে গিয়েছেন বৈঠকে তিনি খুব খুশি। দু’দেশের সম্পর্কে একটি নতুন যুগ শুরু হতে চলেছে।’’
কাশ্মীর নিয়ে কোনও অস্বস্তি যাতে মাঝপথে তৈরি না-হয়, সে জন্য কোনও প্রশ্ন ওঠেনি মমল্লপুরমে শি-মোদীর দু’দফার বৈঠকে। কূটনৈতিক সূত্রের মতে, এই বৈঠকের সবচেয়ে বড় সাফল্য হল, কাশ্মীর নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে এবং দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে যে চাপ তৈরি করা শুরু করেছিল বেজিং, তার থেকে বেরিয়ে কিছুটা খোলা বাতাস বইয়ে দেওয়া গিয়েছে সম্পর্কে। আপাতত কাশ্মীর নিয়ে কোনও বড় মাপের বিরোধিতা বেজিংয়ের পক্ষ থেকে আসবে না— এমনটাই আশা করা হচ্ছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার মতে, ‘দ্বিপাক্ষিক স্বস্তি’ই হল মমল্লপুরমের মূল কথা। দুই শীর্ষ নেতার এই বৈঠককে চলতি পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের জন্য বার্তাবহ বলেও মনে করা হচ্ছে।
মোদী-শি দ্বিতীয় দফার বৈঠক। মমল্লপুরমের রিসর্টে, শনিবার। ছবি- পিটিআই
গত কাল প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে মহাবলীপুরম মন্দির ঘুরে দেখেন চিনফিং, যা এখন মমল্লপুরম নামে পরিচিত। তার পর একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন দুই রাষ্ট্রপ্রধান। অনুষ্ঠানের পর নৈশভোজও সারেন তাঁরা।
শুক্রবার রাতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিদেশ মন্ত্রকের তরফে বলা হয়, ‘‘কট্টরপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে সাধারণ চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিবেচনা করে ভারত ও চিন তার বিরুদ্ধে এক সঙ্গে লড়াই করতে রাজি হয়েছে।’’
গত কালের মতো এ দিনও প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং শি চিনফিং মমল্লপুরম সমুদ্রসৈকতে তাজ ফিশারম্যানস কোভ রিসর্ট এবং স্পায় এক সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁদের বৈঠক ছাড়াও সেখানে দুই দেশের প্রতিনিধিদলেরও বৈঠক হয়। তার পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারেন চিনা প্রেসিডেন্ট।
আরও পড়ুন- শি আসার আগে প্লাস্টিক কুড়িয়ে সমুদ্রসৈকত সাফ করলেন মোদী
আরও পড়ুন- ‘খুবই ভাল সময় কাটিয়েছেন’, মোদী-চিনফিং-এর বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক স্বস্তির ছবি মমল্লপুরমে
শুক্রবার দুই রাষ্ট্রনেতাই দোভাষীর সাহায্যে বাণিজ্য ঘাটতি-সহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সেই আলোচনা ছিল এতটাই ঘরোয়া যে, সেখানে বিভিন্ন রকমের স্থানীয় তামিল খাবারদাবারের প্রসঙ্গও উঠে আসে।
বিদেশসচিব বিজয় গোখলে পরে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘আলোচনা প্রায় দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলেছে। যা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি। আর তা হয়েছে খুব উন্মুক্ত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। দুই নেতাই একে অপরের সঙ্গে ভাল সময় কাটিয়েছেন।’’
শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদী ভেস্তির তামিল পোশাকে, সাদা শার্ট এবং একটি ‘অঙ্গবস্ত্র’ পরে, শিকে সঙ্গে নিয়ে অর্জুনের তপস্যা, কৃষ্ণের বাটারবল, পঞ্চরথ এবং মন্দিরের সমস্ত ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলি ঘুরে দেখান। প্রাচীন মন্দির শহর থেকেই, দুই নেতার মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনের সূচনা হয়। যা একেবারেই আনুষ্ঠানিক ছিল না। প্রধানমন্ত্রী মোদীর উহান সফরের সময় চিনা প্রেসিডেন্ট তাঁকে হুবেই প্রাদেশিক জাদুঘর ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন।
দুই রাষ্ট্রনেতার একান্ত প্রায় আড়াই ঘণ্টার নৈশভোজের পরে বিদেশসচিব বললেন, ‘‘মোট পাঁচ ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। দুই নেতা খুবই ভাল সময় কাটিয়েছেন। কথা হয়েছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারতের ঘাটতি, নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুঁজে বার করা নিয়ে। দু’দেশই মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের শিকার। স্থির হয়েছে, সন্ত্রাসবাদ যাতে দু’দেশের বহুস্তরীয় সংস্কৃতি ও সমাজকে বিনষ্ট না করতে পারে সে জন্য একত্রে কাজ করা হবে।’’
বিদেশসচিবের বক্তব্য, দুই নেতাই একে অপরকে তাঁদের জাতীয় দর্শন কী তা জানিয়েছেন এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার পথে কী ভাবে এগোনো যায়, তা নিয়ে কথা বলেছেন।
চিনা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘‘তামিলনাড়ুর সঙ্গে চিনের পারস্পরিক মত বিনিময় এবং সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাসকে এমন ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিকাশ আরও দীর্ঘস্থায়ী হয় আর তা এশীয় সভ্যতার পক্ষে নতুন গৌরবের হয়।’’
চিনা প্রেসিডেন্ট শুক্রবার বিকেলে ‘এয়ার চায়না বোয়িং ৭৪৭’ বিমানে চড়ে ভারতে আসেন। তাঁকে চেন্নাইয়ে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ই কে পলানিস্বামী, রাজ্যপাল বানওয়ারিলাল পুরোহিত, তামিলনাড়ু বিধানসভার অধ্যক্ষ পি ধনপাল এবং চিনে ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম মিস্রি। চিনের প্রেসিডেন্টকে সম্মান জানাতে একটি সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং চিনা প্রেসিডেন্টের মধ্যে প্রথম অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ সম্মেলনটি হয় গত বছর, ডোকলামে। দু’দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ৭৩ দিনের চাপানউতরের কয়েক মাস পর। সেই বৈঠক হয়েছিল চিনের হ্রদ শহর উহানে।
তিন দিন আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে বৈঠকের পর ভারত সফর আসেন চিনের প্রেসিডেন্ট।
গত কাল মমল্লপুরমে প্রাচীন মন্দির পরিদর্শনের ফাঁকে ডাবে চুমুক দিতে দিতে অথবা মন্দিরের নৃত্যানুষ্ঠানের অবসরে দোভাষীদের সঙ্গে নিয়ে একনাগাড়ে কথা বলে গিয়েছেন মোদী এবং শি। এ দিন মধ্যাহ্নভোজ সেরেই নেপালের বিমান ধরার জন্য রওনা হয়ে যান চিনা প্রেসিডেন্ট।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, এই স্বল্পমেয়াদি সফরে মাইলফলক কোনও সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল না। হয়ওনি। প্রতীকী ছবিই কূটনীতিতে বার্তাবহ, যা এ বার এশিয়ার দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতা অকাতরে বিলিয়েছেন।