মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী (যিনি অচিরেই শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হবেন) রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্কের দাবি, এই পদক্ষেপ ঐতিহাসিক। ছবি: পিটিআই।
মাঝে শুধু ১৯৯২ সালের ‘সামান্য সংশোধন’। সেটুকু সরিয়ে রাখলে, সেই ১৯৮৬ সালের পরে এই প্রথম নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করল কেন্দ্র। বুধবার তাতে সিলমোহর দিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। এর হাত ধরে বদলে গেল মন্ত্রকের নামও! সরকারি ঘোষণা, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ফিরে যাচ্ছে তার পুরনো নাম শিক্ষা মন্ত্রকে।
স্কুলশিক্ষাকে অধিকার হিসেবে তুলে ধরে ৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি সকলকে স্কুলের চৌহদ্দিতে টেনে আনার স্বপ্ন দেখাল এই নতুন নীতি। বলা হল, মুখস্থে জোর আর পাঠ্যক্রমের বোঝা কমিয়ে জীবনে প্রয়োগযোগ্য শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার কথা। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কম্পিউটার কোডিং কিংবা চার বছরের গবেষণামুখী স্নাতক-পাঠের কথা যেমন বলা হল, তেমনই তুলে ধরা হল পঞ্চম (পারলে অষ্টম) শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা কিংবা স্থানীয় ভাষায় ক্লাসে পড়ানোর প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ। যদিও স্পষ্ট করে দেওয়া হল, বিষয় হিসেবে ইংরেজি থাকছেই।
তবু নতুন নীতি ঘিরে ধোঁয়াশা আর বিক্ষোভ বিস্তর। যেমন অনেকের প্রশ্ন, সব স্কুলেই কি তবে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় ভাষায় পড়ানো বাধ্যতামূলক? সে ক্ষেত্রে তামিলনাড়ু থেকে বদলি হয়ে বাংলায় আসা অফিসারের মেয়ে ক্লাসে পড়া বুঝবে কী করে! এ বছর থেকে কি তবে এম-ফিলে ভর্তি নেবে না কোনও বিশ্ববিদ্যালয়? স্থানীয় ভাষার নাম করে কি পরে কৌশলে ঢোকানোর চেষ্টা হবে হিন্দি? খসড়া প্রস্তাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যা বাধ্যতামূলক করার কথা রাখায় প্রবল ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল কেন্দ্রকে। কবে থেকে এই নির্দেশিকা কার্যকর করা হবে, তা-ও স্পষ্ট নয় এখনও।
আরও পড়ুন: কংগ্রেস রাজনীতিতে এক অধ্যায়ের অবসান, প্রয়াত সোমেন মিত্র
আরও পড়ুন: আনলক ৩ পর্বে খুলছে জিম, যোগ কেন্দ্র, নয়া গাইডলাইন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের
মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী (যিনি অচিরেই শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হবেন) রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্কের দাবি, এই পদক্ষেপ ঐতিহাসিক। কিন্তু বিরোধীশাসিত অনেক রাজ্যেরই অভিযোগ, এ আসলে শিক্ষার কেন্দ্রীকরণের চেষ্টা। করোনার এই সময়কে ঢাল করে যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণের মতো বহু সিদ্ধান্ত ‘একতরফা’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তেমনই শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই পথে হাঁটল কেন্দ্র।
স্কুলের নতুন শিক্ষানীতি
• প্রথম শ্রেণিতে পড়ার আগে ৩ বছরের প্রাক্-স্কুল শিক্ষা।
• এখনকার মতো ১০+২ স্কুল শিক্ষার বদলে ৫+৩+৩+৪ ব্যবস্থা।
• পঞ্চম (সম্ভব হলে অষ্টম) শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা/ স্থানীয় ভাষায় ক্লাসে পড়ানো। তবে বিষয় হিসেবে
ইংরেজি থাকছেই।
• প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং তার আগের ৩ বছর মিলে ৫ বছরে ভিত তৈরি।
• তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি প্রস্তুতি পর্ব।
• ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাঝারি পর্বের শিক্ষা।
• নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি মাধ্যমিক শিক্ষা। পরীক্ষা সিমেস্টারে।
• অনেক বেশি ও বিভিন্ন রকম বিষয় একসঙ্গে পড়ার সুযোগ। কিন্তু মৌলিক চিন্তাকে উৎসাহ দিতে
কমবে পাঠ্যক্রমের বোঝা। গুরুত্ব কমবে বোর্ড পরীক্ষারও।
• পরীক্ষায় মুখস্থের বদলে প্রয়োগ ও সমস্যা সমাধানে জোর। স্কুলের পাশাপাশি মূল্যায়ন করবে সহপাঠী, এমনকি পড়ুয়া নিজেও।
• তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বিশেষ পরীক্ষা।
কলেজের নতুন শিক্ষানীতি
• স্নাতক ৩/৪ বছরে। ৪ বছরের স্নাতকের পাঠ শেষ করলে, সুযোগ সরাসরি পিএইচ ডি-র। চাকরিমুখী হলে, যথেষ্ট ৩ বছরই।
• একই ভাবে স্নাতকোত্তরও ১/২ বছরের।
• থাকবে না এম-ফিল।
• এক টানে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করতে না-পারলে, সেখান থেকেই তা শেষের সুযোগ। আগের গ্রেড বা নম্বর জমা থাকবে ডিজিটাল লকারে।
• কেউ এক বা দু’বছর পড়ে কলেজ ছেড়ে দিলেও জলে যাবে না তা। এক থেকে চার বছর শেষে যথাক্রমে সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, ডিগ্রি, অনার্স।
• উচ্চশিক্ষার জন্য একটিই নিয়ন্ত্রক। আলাদা ভাবে থাকবে না ইউজিসি, এআইসিটিই। মানের নিরিখে বহু কলেজকে পরিচালন-স্বাধীনতা।
সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির প্রশ্ন, সংবিধান অনুযায়ী, শিক্ষা কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ দায়িত্ব। তা হলে তাদের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা ছাড়া কেন ‘একতরফা শিক্ষা নীতি’ ঘোষণা করা হল? কেন এড়িয়ে যাওয়া হল সংসদকে? তাঁর মতে, এ আসলে শিক্ষার কেন্দ্রীকরণ, গৈরিকীকরণ এবং বাণিজ্যকরণের চেষ্টা। একই অভিযোগ এসএফআই, এআইএসএ-র মতো ছাত্র সংগঠনগুলিরও।
কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। ছবি: পিটিআই।
এ দিন মন্ত্রী নিশঙ্ক এবং শিক্ষাসচিব অমিত খারের দাবি, এই নীতি চূড়ান্ত করার আগে সংসদ, রাজ্য, শিক্ষামহল থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষের সঙ্গে চর্চা হয়েছে প্রচুর। এমনও নয় যে, কাল থেকেই এই নীতি কার্যকর হবে। এ কথা ঠিক যে, আজ-কালের মধ্যেই এই নীতির জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করবে সরকার। কিন্তু তাকে পুরোদস্তুর কার্যকর করতে অনেকটা পথ বাকি। যেমন, উচ্চশিক্ষায় সাধারণত কেন্দ্রীয় নিয়মেরই ওজন বেশি। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত বদল আনতে সংশোধন জরুরি সংশ্লিষ্ট আইনে। ফলে সেই সংক্রান্ত বিল পাশ করাতে হবে সংসদে। দ্বিতীয়ত, স্কুলশিক্ষায় এই সমস্ত পরিবর্তন কার্যকর করতে কথা বলতে হবে প্রতিটি রাজ্যের সঙ্গে। নিতে হবে সেখানকার শিক্ষা দফতর ও বোর্ডের মতামত।
বিরোধীদের প্রশ্ন, তা হলে কেন অপেক্ষা করা গেল না সংসদ খোলা পর্যন্ত? রাজ্যের সঙ্গে বৈঠকেই যদি বসতে হয়, তবে নীতি চূড়ান্ত করার আগেই তা না-করার কারণ কী? তাঁরা জানাচ্ছেন, এই নীতিতে শিক্ষার বাণিজ্যকরণের রাস্তায় কতটা হাঁটা হয়েছে, কতটা খোলা হয়েছে ফি বৃদ্ধির রাস্তা, সরকারি উচ্চ শিক্ষায় গুরুত্ব কমানো হচ্ছে কি না— এই সব কিছু খতিয়ে দেখে বিশদে মুখ খুলবেন তাঁরা। কেন্দ্রের পাল্টা যুক্তি, গত পাঁচ বছর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। চাইলে নিজের বক্তব্য জানাতেই পারত যে কোনও রাজ্য।
তবে বিরোধীদের কটাক্ষ, এক দেশ-এক ধর্ম, এক দেশ-এক ভাষার মতো এ বার এক দেশ-এক শিক্ষার বাসনা পূর্ণ করতেই রাজ্যের মতকে অগ্রাহ্য করার পথে হেঁটেছে কেন্দ্র।