একে ২২ সেমি-অটোম্যাটিক রাইফেল।
মুঙ্গেরের দিশি বন্দুকে আর ভরসা নেই। বিহারে জঙ্গি থেকে মাফিয়া, সুপারি কিলার থেকে মহল্লার মাস্তান— সকলেরই হাতে হাতে এখন রোমানিয়ায় তৈরি অ্যাসল্ট কালাশনিকভ রাইফেল। তবে এই রাইফেল একে-৪৭ বা একে ৫৬-র মতো কুলীন গোত্রের নয়। এর নাম একে-২২।
সেমি অটোমেটিক এই রাইফেল এত দিন ব্যবহার হয়েছে, বিভিন্ন দেশের পুলিশ বা ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণে। কিন্তু বাজারে আরও আধুনিক প্রশিক্ষণ-রাইফেল চলে আসায় হঠাৎই বাজার হারিয়েছে এই নকল অ্যাসল্ট রাইফেল। তার পরই অস্ত্রের কালো বাজার ছেয়ে গিয়েছে পয়েন্ট টুটু বোরের এই হাল্কা রাইফেলে। নেপাল হয়ে বিহারে ঢুকে দেদার বিকোচ্ছে একে-২২। পৌঁছেছে মাওবাদীদের হাতেও। এমনকী সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে বাংলাদেশেও। গুলশনের হামলায় জঙ্গিরা এই রাইফেলই ব্যবহার করেছে। নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি ডেরাতেও আইএস পতাকার সঙ্গে একে-২২ রাইফেল পেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ।
এই সে দিন বিহারের মতিহারিতে একই পরিবারের ৪ জনকে গুলি করে মারা হয়েছে। তদন্তে নেমে পুলিশ দেখে, এই কাজেও লেগেছে একে-২২-ই। নিহত শ্যামভিখারি সহানির সঙ্গে মাওবাদীদের যোগ ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। কয়েকটি খুনের ঘটনায় সে-ও জড়িত ছিল। পুলিশ জেনেছে— মতান্তরের কারণে মাওবাদীরাই এই খুন করেছে। দুইয়ে দুইয়ে চার করে পুলিশ নিশ্চিত— মাওবাদীদের হাতেও পৌঁছে গিয়েছে একে-২২।
শুধু মতিহারির ঘটনাই নয়। মাস খানেক আগে পটনা লাগোয়া গঙ্গার চর এলাকায় বালি মাফিয়াদের লড়াইয়ে দু’জন মারা যায়। সে ক্ষেত্রেও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একে-২২ রাইফেলই উদ্ধার করেছিল। এর আগে পটনা শহরে লোকজনশক্তি পার্টি নেতা ব্রিজবিহারী সিংহও খুন হয়েছিলেন এই রাইফেলেই।
একে-২২ রাইফেলের রমরমায় কপালে ভাঁজ পড়েছে মাওবাদী-বিরোধী অপারেশনের দায়িত্বে থাকা সিআরপি কর্তাদেরও। গয়া-ঔরঙ্গাবাদ সীমানায় সাম্প্রতিক হামলায় এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে মাওবাদীরা। এর পরে বিহার-সহ কয়েকটি রাজ্যের এসটিএফ এবং এটিএস-কে এই রাইফেলের ‘সাপ্লাই-লিঙ্ক’ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।
কিন্তু বাংলাদেশের জঙ্গিদের হাতে কী ভাবে পৌঁছল একে-২২? গোয়েন্দারা বলছেন, পড়শি দেশের সাধারণ দুষ্কৃতী থেকে জঙ্গি— সকলেই অস্ত্র আনে বিহার থেকে। এত দিন মুঙ্গেরের কারিগরদের বানানো দেশি বন্দুক-পিস্তলই ব্যবহার করত তারা। তার বদলে এখন একে-২২ রাইফেল যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে।
কোন পথে একে-২২ রাইফেল বাংলাদেশে পাড়ি দিচ্ছে, সে বিষয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে ও দেশের পুলিশ। তারা জানাচ্ছে, নেপাল থেকে বিহারে আসা একে-২২ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সেখান থেকে তা যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে। বাংলাদেশে জঙ্গিদের ভাঁড়ারে একে-২২ রাইফেলের ভাল মজুত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন সে দেশের গোয়েন্দা কর্তারা।
বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের পাঠানো রিপোর্ট আইবি এবং এনআইএ-র কাছে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ। তবে কোথা থেকে ওই অস্ত্র নেপালে ঢুকছে, তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি কোনও মহল। পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা নেপালে সক্রিয় রয়েছে বলে সূত্রের ইঙ্গিত। সম্ভবত তারাই বিহারে পাঠাচ্ছে এই রাইফেল।
অস্ত্র বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, রোমানিয়ায় তৈরি আধা স্বয়ংক্রিয় একে-২২ রাইফেল থেকে প্রতি মিনিটে ৫০টিরও বেশি গুলি বেরোয়। একে-৪৭-এর নকল করে বানানো এই রাইফেল আমেরিকায় খোলা বাজারেই বিকোয়। দাম শ’তিনেক ডলার। প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার হয়ে বলে এই রাইফেলের আর এক নাম ‘ট্রেনার’।
সেই রাইফেলই এখন ব্যবসা কাড়ছে মুঙ্গেরের বন্দুক কারিগরদের।