গ্রাফিক— সনৎ সিংহ।
এখন যেখানে অযোধ্যার রামমন্দির, সেখানে আগে কী ছিল? উত্তর বাবরি মসজিদ নয়। এনসিইআরটি-র নতুন পাঠ্যপুস্তক বলছে, ‘‘সেখানে ছিল তিনটি গম্বুজওয়ালা এক স্থাপত্য। যা ১৫২৮ সালে তৈরি করা হয়েছিল রামের জন্মস্থলে। যার দেওয়াল জুড়ে ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতীক এবং হিন্দু পুরাণের নিদর্শনের ছড়াছড়ি।’’
গত সপ্তাহেই প্রকাশিত হয়েছে এনসিইআরটি (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং)-এর দ্বাদশ শ্রেণির এই ‘সংশোধিত’ পাঠ্যপুস্তিকা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ে চোখে পড়ার মতো সংশোধনী আনা হয়েছে অযোধ্যার অধ্যয়ে। পুরনো বইয়ে অযোধ্যার ইতিহাসের যে বিবরণ ছিল চার পাতা জুড়ে, নতুন বইয়ে তা শেষ করে দেওয়া হয়েছে দু’পাতাতেই। বাদ গিয়েছে বাবরি মসজিদ নাম। এবং আরও অনেক কিছু।
এনসিইআরটি হল কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের অধীন একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা।
তাদের নতুন সংশোধিত অযোধ্যার ইতিহাসে বাদ দেওয়া হয়েছে, বিজেপির সোমনাথ থেকে অযোধ্যা রথযাত্রার কথা, বাবরি ধ্বংসে করসেবকদের ভূমিকা, সাম্প্রদায়িক অশান্তি, তৎকালীন বিজেপিশাসিত রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়া এমনকি, বিজেপি সরকারের অনুশোচনামূলক বিবৃতিও। এর কোনওটিরই উল্লেখ নেই নতুন বইয়ে। বদলে লেখা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে ওই তিন গম্বুজ বিশিষ্ট স্থাপত্যের তালা খোলার পর যখন সেখানে কিছু মানুষকে প্রার্থনার অনুমতি দেয় ফৈজাবাদ আদালত, তখন হিন্দুরা অবহেলিত বোধ করেছিলেন। বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘হিন্দুরা মনে করেছিলেন, রাম জন্মভূমি এবং ভগবান শ্রীরামকে নিয়ে তাঁদের আবেগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অন্য দিকে মুসলিম সম্প্রদায় চেয়েছিল ওই স্থাপত্যের উপর তাঁদের অধিকার কায়েম করতে।’’
যদিও এনসিআরটিইর বক্তব্য, এই সবই করা হয়েছে পড়ুয়াদের সামনে ইতিহাসের ইতিবাচক বিষয়টি তুলে ধরার জন্য। সাম্প্রদায়িক অশান্তির কথা দেশের ভবিষ্যতকে জানানোর প্রয়োজন নেই বলেই মনে করছে তারা।
এনসিইআরটির পাঠ্যক্রম মেনে চলে সিবিএসই বোর্ড। আইসিএসই এবং আইএসই বোর্ডও কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে চলে। এই দুই বোর্ডের পড়ুয়াদের জন্যই নির্ধারিত দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে অযোধ্যার অধ্যায়ে ফলাও করে লেখা হয়েছে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের রায়ের কথা। অথচ পুরনো বইয়ে যেখানে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ১৯৯২ সালে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহের সরকারকে আদালতের ভর্ৎসনার কথা লেখা ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে দু’টি সংবাদপত্রের ছবিও। যার একটির শিরোনামে লেখা ছিল, ‘‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য কল্যাণ-সরকারকে বরখাস্ত করা হল’’। অন্যটির শিরোনামে ছিল বাজপেয়ীর বক্তব্য। যেখানে তিনি বলছেন, ‘‘অযোধ্যা হল বিজেপির সবচেয়ে বড় ভুল’’।
বাদ গিয়েছে সেই সব কিছু। রয়েছে শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক রায়। যেখানে আদালতের বেঞ্চ বলছে, ‘‘যে কোনও সমাজেই দ্বন্দ্ব বা সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু যে দেশে বহু জাতির বাস, সেখানে এই ধরনের সংঘাতের সমাধান হয় আইনি প্রক্রিয়ায়। দেশের সংবিধান সর্বধর্ম এবং বিশ্বাসের মানুষের প্রার্থনা করার অধিকারকে সম্মান করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অযোধ্যায় মসজিদ তৈরির অনেক আগে থেকেই ওই এলাকার সঙ্গে হিন্দুদের রাম জন্মভূমির বিশ্বাস জড়িয়ে ছিল। তার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।’’
বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ তৈরির জন্য দেওয়া হয়েছে আলাদা জমি। আর এই সিদ্ধান্ত সমাজের অধিকাংশ মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন। স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে কী ভাবে দু’পক্ষের সম্মতিক্রমে গণতান্ত্রিক ভাবে সমাধান করা যায়, তার ধ্রুপদী উদাহরণ হল অযোধ্যার রায়।’’
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের পর এই নিয়ে চতুর্থ বার সংশোধন করা হল এনসিইআরটির দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক।