মাকে খাইয়েও দিতেন নরেন্দ্র। ছবি প্রধানমন্ত্রীর ব্লগ।
‘মা’ শব্দটা অভিধানের আর পাঁচটা শব্দের মতো নয়। এর সঙ্গে প্রচুর আবেগ জড়িত— ভালবাসা, ধৈর্য্য, বিশ্বাস এবং আরও অনেক কিছু। বিশ্ব জুড়ে, দেশ বা অঞ্চল ভেদ ব্যতিরেকে সন্তানরা মায়ের সঙ্গে স্নেহের সম্পর্কে যুক্ত। মা শুধু সন্তানের জন্মই দেন না, তাদের মন, ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেন। আর এই করতে গিয়ে তিনি বিসর্জন দেন নিজের চাহিদা এবং স্বপ্নকে।
আজকে আমি খুব খুশি এবং সৌভাগ্যবান যে আমার মা শ্রীমতী হীরা তাঁর শততম বছরে পা দিচ্ছেন। এ বছর মায়ের শততম বছর। আমার বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তাঁরও শতবর্ষ পূর্ণ হত গত সপ্তাহে। ২০২২ একটা স্পেশাল বছর। কারণ আমার মায়ের শতবর্ষ শুরু হচ্ছে আর আমার বাবার শতবর্ষ শেষ হত।
গত সপ্তাহেই গান্ধীনগর থেকে আমার ভাইপো মায়ের কয়েকটি ভিডিও পাঠিয়েছে। আশেপাশের কিছু তরুণ আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, আমার বাবার একটা ছবি চেয়ারের উপর রাখা হয়েছিল, আর কীর্তন হচ্ছিল। আর মা ভজন গাইছিলেন এবং মঞ্জিরা বাজাচ্ছিলেন। মা এখনও ঠিক একই রকম আছেন। বয়সে শরীর একটু অশক্ত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মানসিক ভাবে মা সম্পূর্ণ সচেতন।
আগে আমাদের পরিবারে জন্মদিন পালনের তেমন কোনও রীতি ছিল না। তবে পরিবারের তরুণরা আমার বাবার জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে ১০০টি গাছের চারা রোপন করেছিলেন।
আমি নিঃসন্দেহ যে আমার জীবনে যা কিছু ভাল সবই আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। সুদূর দিল্লিতে বসেও আমার অতীতের স্মৃতি মনে পড়ছে।
আমার মা খুবই সরল আবার অনন্যও। অন্যান্য সব মায়ের মতনই। এই যে আমি আমার মায়ের সম্পর্কে লিখছি, আমি নিশ্চিত যে আপনারা অনেকেই আপনাদের মায়ের স্মৃতির সঙ্গে এর মিল পাবেন। পড়তে গিয়ে হয়তো আপনার মায়ের ছবিও মনে আসবে।
মায়ের নিঃস্বার্থতাই ভাল মানুষ তৈরি করে। তাঁর স্নেহ, সন্তানের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও সমমর্মিতা তৈরি করে। মা শুধু একজন ব্যক্তি মানুষই নন, মাতৃত্ব একটি গুণ। আমরা প্রায়ই বলি ভগবান তাঁর ভক্তদের চরিত্রানুযায়ী গঠিত। একই ভাবে আমাদের নিজেদের মানসিকতা এবং স্বভাবের প্রতিফলন আমরা দেখি মা’র মধ্যে।
আমার মায়ের জন্ম গুজরাটের মেহসানা জেলার ভিসনগরে। মা কিন্তু তাঁর মায়ের স্নেহ পাননি। মা’র খুব ছোট বয়সেই স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারিতে আমার দিদিমা মারা যান। মা’র ছোটবেলা কেটেছে মাতৃহীন হয়ে। মা কোনও দিন তাঁর মায়ের কাছে বায়না করতে পারেননি, তাঁর কোলে মাথা দিয়ে শুতে পারেননি। মা স্কুলেও যাননি বা লিখতে-পড়তেও জানেন না। মা’র শৈশবে ছিল শুধুই দারিদ্র আর বঞ্চনা।
আজকের তুলনায় মা’র শৈশব ছিল খুবই কঠিন। হয়তো ঈশ্বর এটাই তাঁর ভাগ্যে লিখেছিলেন। মা’ও এটিকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে মনে করেন। কিন্তু এই যে শৈশবে নিজের মা’কে হারানো বা নিজের মায়ের মুখটাও না দেখতে পাওয়া— এটা মাকে কষ্ট দেয়।
এ সব সংগ্রামের কারণে মা’র শৈশব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বয়সের তুলনায় আগেই মা’কে বড় হয়ে উঠতে হয়েছিল। মা’ই ছিলেন পরিবারের বড় মেয়ে আর বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে বড় বউ। শৈশবে মা তাঁর গোটা পরিবারের দেখভাল করতেন এবং সংসারের সব কাজ করতেন। বিয়ের পরেও মা এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। অজস্র দায়িত্ব এবং প্রতি দিনের সংগ্রাম সত্ত্বেও মা গোটা পরিবারটিকে ধৈর্য্য এবং শক্তি দিয়ে একসূত্রে বেঁধে রেখেছিলেন।
ভাদনগরে আমাদের পরিবার একটা ছোট্ট জানালাহীন বাড়িতে থাকত। শৌচাগারের তো প্রশ্নই নেই। মাটির দেওয়াল আর টালির ছাদের এই ছোট্ট ঘরটিকেই আমরা আমাদের বাড়ি বলতাম। আমি, আমার ভাই-বোনেরা, বাবা-মা সবাই ওই বাড়িতে থাকতাম।
বাঁশ আর কাঠের পাটাতন দিয়ে বাবা একটা মাচান বানিয়েছিলেন যাতে মা’র রান্না করতে সুবিধা হয়। ওটাই ছিল আমাদের রান্নাঘর। মা মাচানের উপর উঠে রান্না করতেন আর আমরা ওখানে বসে খেতাম।
সাধারণত, দারিদ্র ক্লান্ত করে। কিন্তু আমার বাবা-মা দৈনিক সংগ্রামের উদ্বেগের মধ্যেও পরিবারের শান্তি বিঘ্নিত করতে দেননি। বাবা-মা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছিলেন আর তা পালন করতেন।
ঘড়ির কাঁটা ধরে বাবা ভোর ৪টেয় কাজে বেরিয়ে যেতেন। বাবার পায়ের শব্দে প্রতিবেশীরা বুঝতে পারতেন ভোর ৪টে বাজে আর ‘দামোদর কাকা’ কাজে যাচ্ছেন। বাবার আর একটা কাজ ছিল চায়ের দোকান খোলার আগে স্থানীয় মন্দিরে পুজো করা।
মা’ও ছিলেন একই রকমের সময়ানুবর্তী। বাবার সঙ্গে একই সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে সকালের মধ্যেই সংসারের সব কাজ সেরে ফেলতেন। শস্য পেষাই থেকে শুরু করে চাল-ডাল ঝাড়া, মা’র তো আর কোনো সহকারী ছিল না। কাজ করতে করতে গুন গুন করে ভজন গাইতেন মা, ‘জলকমলছরি যানেওয়ালা, স্বামী আমারো জাগাসে।’ ঘুম পাড়ানী গান, ‘শিবাজী নু হালারদু’-ও মা’র খুব পছন্দের ছিল।
মা কখনও চাইতেন না আমরা পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করি। কোনও দিন আমাদের কাছে সাহায্য চানওনি। কিন্তু মাকে অতো কষ্ট করতে দেখে আমরা নিজেরাই বুঝতে পেরেছিলাম যে মাকে সাহায্য করা দরকার। আমি পুকুরে স্নান করতে ভালবাসতাম। সাধারণ ভাবে, বাড়ি থেকে সব কাপড় নিয়ে গিয়ে আমি পুকুর থেকে কেচে আনতাম। কাপড় কাচা আর আমার খেলা দুটোই একসঙ্গে হত।
সংসারের খরচ চালাতে মা দু-একটি বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করতেন। অনেক সময় চরকাও কাটতেন। তুলো ছেঁড়া থেকে সুতো কাটা, সবটাই একা হাতে করতেন। এতো পরিশ্রম সত্ত্বেও মা’র লক্ষ্য থাকত যেন সুতোতে আমাদের হাত না কেটে যায়।
নিজের কাজের জন্য অন্যদের ওপর মা নির্ভর করতেন না। আমাদের মাটির বাড়িতে বর্ষাকালে নানান সমস্যা হতো। আমাদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, মা সে দিকে লক্ষ্য রাখতেন। জুন মাসের প্রচন্ড গরমে মা টালি ঠিক করার জন্য ছাদে উঠতেন। মা’র সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও বর্ষার অত্যাচার সহ্য করার পক্ষে আমাদের বাড়িটা খুবই পুরনো ছিল।
বর্ষার সময় ছাদের ফুটো দিয়ে জল পড়ে ঘর ভেসে যেত। বালতি, বাসন বসিয়ে মা বর্ষার জল ধরে রাখতেন। ওই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মা কিন্তু শান্ত থাকতেন। অবাক হবেন এটা জেনে যে মা ওই জলটা পরবর্তী কয়েক দিন নানা কাজে ব্যবহার করতেন। এ এক প্রকার জল সংরক্ষণের উদাহরণ।
বাড়ি সাজাতে মা ভালোবাসতেন আর পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুজিয়ে রাখার জন্য অনেক সময়ও ব্যয় করতেন। গোবর দিয়ে মেঝে নিকিয়ে রাখতেন। ঘুঁটে জ্বালালে ভীষণ ধোঁয়া হত আর মা আমাদের ওই জানলাহীন বাড়িতে বসে রান্না করতেন। দেয়ালগুলি ঝুলে কালো হয়ে যেতো, আর তার ওপরে কয়েক মাস অন্তর অন্তরই রঙের প্রয়োজন হত। রঙও মা নিজেই করতেন। রঙের ফলে আমাদের ভাঙাচোরা বাড়িটাকেও একটু ভালো দেখতো লাগতো। বাড়িতে সাজাবার জন্য মা ছোট ছোট সুন্দর মাটির পাত্র তৈরি করতেন। আর সংসারের পুরনো জিনিস পুনর্ব্যবহারে তো মা সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
মার আর একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল, পুরনো কাগজ জলে ভিজিয়ে রেখে, তার সঙ্গে তেঁতুল বিচি মিশিয়ে আঁঠার মতন একটা জিনিস তৈরি করতেন। দেওয়ালে এই আঁঠা লেপে তার ওপরে আয়নার টুকরো আটকে অসাধারণ ছবি বানাতেন মা। দরজায় স্থানীয় বাজার থেকে কেনা ঘর সাজাবার জিনিস ঝুলিয়ে রাখতেন।
বিছানা ঠিকভাবে পরিষ্কার করে টানটান করে পাতা হয়েছে, মা এ বিষয়ে খুব সচেতন ছিলেন। খাটের ওপর একফোঁটা ধুলো থাকতে পারবে না। চাদর একটুও কুঁচকে যাওয়া মানেই আবার করে বিছানা ঝেড়ে পাততে হবে। এই অভ্যেসটার বিষয়ে আমরা সকলেই খুব সচেতন ছিলাম। এমনকি এই বয়সেও মা কুঁচকানো বিছানার চাদর পছন্দ করেন না।
সবকিছু নিঁখুত করার এই অভ্যাস এখনও বজায় আছে। আর যদিও মা এখন আমার ভাই আর ভাইপোর পরিবারের সঙ্গে গান্ধীনগরে থাকেন, কিন্তু মা এখনও নিজের কাজ নিজেই করার চেষ্টা করেন।
পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতার দিকে মার দৃষ্টি এখনও তীক্ষ্ণ। গান্ধীনগরে গেলে মা নিজের হাতে আমাকে মিষ্টি খেতে দেন। খাওয়া হয়ে গেলে একটা তোয়ালে দিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো আমার মুখ মুছিয়ে দেন। মায়ের শাড়িতে সবসময় একটা ছোটো তোয়ালে গোঁজা থাকে।
পরিচ্ছন্নতা নিয়ে মায়ের দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয়ে আমি পাতার পর পাতা লিখতে পারি। যারা পরিচ্ছন্নতা এবং স্বচ্ছতার কাজে জড়িত তাদের প্রতি মা’র গভীর শ্রদ্ধা ছিল। ভাদনগরে আমাদের বাড়ির পাশের নর্দমা পরিষ্কার করতে যখনই কেউ আসতেন মা তাদেরকে চা খাওয়াতেন। কাজের পরে চা পাওয়া যাবে এই কারণে আমাদের বাড়ি সাফাই কর্মচারীদের কাছে বিখ্যাত ছিল।
অন্য পশু-পাখির প্রতি মা’র স্নেহ-ও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গরমকালে পাখিদের জন্য মা জল রেখে দিতেন। আমাদের বাড়ির আশেপাশের রাস্তার কুকুরদের কখনও খাবারের অভাব হতোনা।
বাবার চায়ের দোকানের দুধের সর দিয়ে মা ঘি বানাতেন। এই ঘি শুধু আমরাই খেতাম না, প্রতিবেশীদের গরুরাও তার ভাগ পেতো। এই গরুরা প্রতিদিন সকালে মা’র কাছ থেকে রুটি পেতো। আর শুকনো রুটির বদলে মা তাতে ঘি মাখিয়ে দিতেন।
মা’র নির্দেশ ছিল একদানা খাবারও নষ্ট করা যাবেনা। পাড়ায় কোনো বিয়ে বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রণ হলে মা বারবার করে মনে করিয়ে দিতেন যেনো আমরা কোনো খাবার নষ্ট না করি। বাড়িতে পরিষ্কার নির্দেশ ছিল- যতটা খেতে পারবে ততটা খাবারই নাও।
আজ পর্যন্ত মা একটুও খাবার নষ্ট করেন না। সময়ে খান এবং ভালো করে চিবিয়ে খাবার হজম করেন।
অন্যদের আনন্দে মা খুশি হন। আমাদের বাড়ি খুব ছোট্ট ছিল ঠিকই কিন্তু মা’র হৃদয় ছিল বিশাল। কাছাকাছি গ্রামে বাবার এক বন্ধু থাকতেন। অকালে তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর ছেলে আব্বাসকে বাবা আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের বাড়ি থেকেই আব্বাস তার পড়াশোনা শেষ করেছিল। আমাদের ভাই-বোনদের প্রতি মা যতটা যত্নবান ছিলেন আব্বাসের প্রতিও ততটাই। প্রতি বছর ঈদে মা ওর পছন্দের খাবার বানাতেন। উৎসবের সময় পাড়ার সব বাচ্চারা আমাদের বাড়ি আসতো মায়ের বানানো খাবারের লোভে।
পাড়ায় কোনো সাধু এলে, মা তাঁদের একবার বাড়িতে ডাকবেনই। নিজের জন্য কিছু চাইতেন না, কিন্তু চাইতেন সাধুরা তাঁর সন্তানদের আর্শীবাদ করুন। “আমার সন্তানদের আর্শীবাদ করুন যাতে ওরা অন্যের খুশিতে খুশি হতে পারে আর অন্যের দুঃখে সমমর্মী হয়। ওদের মনে যেনো ভক্তি আর সেবা ভাব থাকে।”
আমার বিষয়ে মা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। আমি যখন সংগঠনের কাজ করতাম তখনকার একটা ঘটনা বলি। সংগঠনের কাজ নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। আমার দাদা সেই সময় মা’কে কেদার-বদ্রী তীর্থ করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কেদারনাথে স্থানীয়রা জানতে পেরেছিল যে আমার মা বদ্রীনাথ থেকে কেদারনাথ আসবেন।
হঠাৎ করে আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেলো। কিছু লোক ওপর থেকে কম্বল নিয়ে নিচে নেমে এসেছিলেন। রাস্তায় যে কোন বয়স্ক মহিলা দেখলেই তাঁরা জিজ্ঞাসা করছিলেন, তিনি নরেন্দ্র মোদীর মা কি না। শেষমেষ তাঁদের সঙ্গে মায়ের দেখা হল, আর মাকে তাঁরা কম্বল, চা দিলেন। কেদারনাথে মায়ের থাকার ভালো ব্যবস্থা তাঁরা করেছিলেন। এই ঘটনা মা’র ওপর প্রভাব ফেলেছিল। পরে আমার সঙ্গে দেখা হতে মা বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে তুমি কিছু ভালো কাজ করেছো, অনেক লোক দেখছি তোমাকে চেনে।”
বহু বছর পরে এখন যদি মা কে কেউ জিজ্ঞাসা করেন ছেলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তাঁর গর্ব হয় কি না, মা জবাব দেন, “আমি তোমারই মতন গর্বিত। আমার কিছুই নয়। ভগবানের ইচ্ছাপূরণে আমি সামান্য সাধন মাত্র।”
আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে মা আমার সঙ্গে যাননি। অতীতেও মাত্র দু’বারই মা আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন। একবার আমেদাবাদে, শ্রীনগরে লালচকে একতা যাত্রা সম্পন্ন করার পর জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে আমি ফিরে আসার পর মা আমার কপালে তীলক এঁকে দিয়েছিলেন।
এটা ছিল মায়ের জন্য এক অত্যন্ত আবেগময় মুহূর্ত কেননা, একতা যাত্রার সময় ফাগওয়ারাতে সন্ত্রাসবাদী হামলায় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছিল। তিনি তাই সেই সময় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। আমার খোঁজ নিতে তখন দু’জন যোগাযোগ করেছিলেন আমার সঙ্গে। এদের একজন হলেন অক্ষরধাম মন্দিরের শ্রদ্ধে প্রমুখ স্বামী, আর অন্যজন হলেন আমার মা। আমার সঙ্গে কথা বলার পর, ওঁর উদ্বেগ হ্রাস হওয়াটা ছিল লক্ষ্যণীয়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হ’ল–যখন আমি ২০০১ সালে প্রথমবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলাম। দু’দশক আগের এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি-ই হ’ল আমার সঙ্গে কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে মা’র শেষবার অংশগ্রহণ। সেই থেকে কোনও সরকারি অনুষ্ঠানেই মায়ের সঙ্গলাভের সৌভাগ্য আমার হয়নি।
আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর আমার সব শিক্ষকদের প্রকাশ্যে সংবর্ধনা জানাতে চেয়েছিলাম। আমি ভাবতাম যে, মা হলেন জীবনে আমার সবচেয়ে বড় শিক্ষক, আর তাই ওঁকেও আমার সম্মান জানানো উচিৎ। এমনকি, আমাদের শাস্ত্রেও বলে যে, মায়ের থেকে বড় গুরু কারোরই আর হয় না– ‘নাস্তিমাত্রোসমগুরু ’আমি মা’কে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা সত্ত্বেও মা তা প্রত্যাখান করেন। তিনি বলেছিলেন, “দেখ, আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমি হয়তো তোমাকে জন্ম দিয়েছি কিন্তু তুমি ঈশ্বরের দ্বারাই শিক্ষালাভ করে বড় হয়ে উঠেছো”। সেই দিন মা ছাড়া আমার সব শিক্ষকই সংবর্ধিত হয়েছিলেন।এছাড়া, ঐ অনুষ্ঠানের আগে মা জানতে চেয়েছিলেন, আমাদের স্থানীয় শিক্ষক, জেঠাভাই যোশীজীর পরিবার থেকে কেউ ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন কিনা। যোশীজী আমার শিক্ষারম্ভের পর্বে আমার শিক্ষক ছিলেন এবং আমার বর্ণ পরিচয়ও হয় তাঁর হাতেই। মা তাঁকে মনে রেখেছিলেন এবং জানতেন যে, তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। যদিও মা সেই অনুষ্ঠানে যাননি কিন্তু তিনি খেয়াল রেখেছিলেন, যাতে আমি জেঠাভাই যোশীজীর পরিবারের কাউকে অবশ্যই আমন্ত্রণ জানাই।
মা আমাকে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, প্রথাগতভাবে শিক্ষালাভ ছাড়াও শিক্ষিত হওয়া যায়। তাঁর চিন্তাভাবনা ও দূরদর্শিতা আমাকে সবসময়েই অবাক করে দেয়।
তিনি সবসময়েই নাগরিক হিসাবে তাঁর কর্তব্য সম্পর্কে খুবই সচেতন। নির্বাচন শুরুর সময় থেকে তিনি প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন, পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত। কয়েকদিন আগে মা গান্ধীনগর পুর কর্পোরেশন নির্বাচনেও ভোট দিতে গিয়েছিলেন।
মা সবসময়েই আমাকে বলেন, আমার কোনও ক্ষতিই হতে পারে না, কেননা আমি ঈশ্বর ও জনসাধারণ সবারই আশীর্বাদ পেয়ে থাকি। তিনি আমাকে মনে করিয়ে দেন যে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা আর ব্যক্তিগতভাবে ভালো থাকাটা জনসেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়।
আগে মা চতুর্মাস প্রথা খুব কঠোরভাবে পালন করতেন। নবরাত্রির সময় আমার নিজস্ব ব্যক্তিগত অভ্যাস সম্পর্কেও তিনি অবহিত। এখন তিনি আমাকে বলতে শুরু করেছেন যে, আমি দীর্ঘদিন ধরে এইসব অভ্যাস কঠোরভাবে পালন করে আসছি বলে এবার এইসব কিছুটা শিথিল করাও দরকার।
মাকে কোনও কিছু নিয়েই কখনও কোনও অভিযোগ করতে শুনিনি। কারও সম্পর্কেও কোনও অভিযোগ তাঁর নেই বা তিনি কারও থেকে কিছু প্রত্যাশাও করেন না।আজ পর্যন্ত মায়ের নামে কোনও সম্পত্তি কিছু নেই। আমি তাঁকে কোনো দিনই স্বর্ণালঙ্কার পরতে দেখিনি। আর তাঁর এ বিষয়ে কোনও উৎসাহও নেই। আগের মতোই তিনি আজও তাঁর ছোট্ট ঘরটিতে অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে জীবনযাপন করে যাচ্ছেন।
ঈশ্বরের প্রতি মা’র অসীম বিশ্বাস। কিন্তু, একই সঙ্গে তিনি কুসংস্কার থেকে দূরে থেকেছেন এবং আমাদের মধ্যেও সেই একই গুণাবলীর সঞ্চার করেছেন। পরম্পরাগতভাবে তিনি কবীরপন্থী আর তাঁর দৈনন্দিন প্রার্থনায় তিনি সেই প্রথা আজও মেনে চলেন। জপমালা নিয়ে জপ করায় তিনি রোজই দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। দৈনিক পূজা ও জপ ইত্যাদিতে মগ্ন থেকে প্রায়ই তিনি নিদ্রাও এড়িয়ে যান। কখনও কখনও আমাদের পরিবারের অন্যরা তাঁর জপের মালাটি লুকিয়ে রাখে, যাতে তিনি ঘুমোতে পারেন।
এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও মায়ের এখনও স্মৃতিশক্তি ভালোই। বহু বছর আগের ঘটনাও তিনি স্পষ্ট মনে করতে পারেন। আমাদের বাড়িতে যখন কোনও আত্মীয় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, মা সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের দাদু-দিদার নাম ধরে ডেকে সেই অনুযায়ী এদেরও চিনে ফেলেন।
বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কেও মা খবরাখবর রাখেন। সম্প্রতি আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি রোজ কতক্ষণ টেলিভিশন দেখেন। জবাবে, মা বলেছিলেন, টেলিভিশনে বেশিরভাগ লোকই তো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে ব্যস্ত আর তাই তিনি সেইসব লোককেই দেখেন, যাঁরা শান্তভাবে খবর পড়েন এবং সবকিছু ব্যাখ্যা করে দেন। আমি অবাক হয়েছিলাম, একথা জেনে যে, মা এত কিছুর খবর রাখেন।
তাঁর তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের জন্য কাশীতে প্রচারপর্ব সেরে আমি আমেদাবাদ গিয়েছিলাম। মায়ের জন্য আমি প্রসাদ নিয়ে যাই, যখন আমি মায়ের সঙ্গে দেখা করি, মা তখনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কাশী বিশ্বনাথ মহাদেবের চরণে শ্রদ্ধার্পণ করেছি কিনা। মা এখনও কাশী বিশ্বনাথ মহাদেব পুরো নামটি উচ্চারণ করেন। এ প্রসঙ্গে কথা বলার সময় মা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের যাওয়ার গলিপথগুলি এখনও সেরকমই আছে কিনা, যেন প্রত্যেকের বাড়ির মধ্যেই একটি করে মন্দির রয়েছে। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, মা কবে কাশী গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, বহু বছর আগে তিনি কাশী গিয়েছিলেন কিন্তু এখনও তাঁর সবই মনে আছে।
মা যে শুধুই ভীষণ রকম সংবেদনশীল ও যত্নশীলা, তাই নয়, তিনি অত্যন্ত প্রতিভাসম্পন্নাও বটে। ছোট ছেলেমেয়েদের চিকিৎসার জন্য অসংখ্য ঘরোয়া টোটকা তাঁর জানা। আমাদের বড়নগরের বাড়িতে প্রতিদিন সকালে বাচ্চাদের দেখাতে ও চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা বাবা-মায়ের লাইন পড়ে যেত।
চিকিৎসার জন্য মায়ের প্রায়ই খুব মিহি একটা পাউডারের প্রয়োজন হ’ত। এই পাউডার যোগাড় করাটা আমাদের ছেলেমেদের যৌথ দায়িত্ব ছিল। মা আমাদের উনুন থেকে ছাই, একটা পাত্র এবং খুব মিহি কাপড় দিতেন। আমরা পাত্রের উপরে কাপড় বেঁধে তার উপর কিছুটা ছাই রাখতাম। এরপর, আমরা খুব ধীরে ধীরে ঐ ছাই কাপড়ের উপর ঘোষতাম যাতে সবচেয়ে সূক্ষ্ম কণাগুলোই নীচে পড়ে। মা আমাদের বলতেন, “কাজটা ভালো করে করো। বাচ্চারা যেন বড় বড় টুকরোর দরুণ কষ্ট না পায়”।
আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে, যেটা থেকে মায়ের অন্তরের স্নেহ ও উপস্থিত বুদ্ধির প্রমাণ মেলে। একবার আমাদের পরিবার বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী, নর্মদাঘাটে পুজোর জন্য যায়। প্রচণ্ড তাপের হাত থেকে রেহাই পেতে আমরা খুব ভোরেই এই তিন ঘন্টার সফর শুরু করেছিলাম। যাত্রা শুরুর পর, তখনও কিছুটা রাস্তা পায়ে হাঁটা বাকি। যেহেতু তখন অত্যন্ত গরম ছিল, আমরা নদী তীর বরাবর জলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। জলের মধ্যে হাঁটাটা মোটেই সহজ ছিল না আর খুব তাড়াতাড়ি আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্থ হয়ে পড়ি। মা আমাদের অস্বস্তিটা তৎক্ষণাৎ খেয়াল করে বাবাকে একটু থামতে ও কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। সেই সঙ্গে, মা বাবাকে বলেন, কাছাকাছি কোথা থেকে একটু গুড় কিনে নিয়ে আসতে। বাবা ছুটে যান এবং তা সংগ্রহ করতেও সক্ষম হন। ঐ গুড় ও জল আমাদের তাৎক্ষণিক শক্তি যোগায় এবং আমরা ফের হাঁটতে শুরু করি। ঐ প্রচন্ড গরমে পুজোর উপলক্ষে যাওয়ার সময় মায়ের সতর্ক দৃষ্টি ও বাবার দ্রুত গুড় আনার ফলে আমাদের যে স্বস্তি মেলে, তা এখনও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে।
ছোটবেলা থেকেই মাকে অন্যদের পছন্দকে কেবল সম্মান জানাতেই নয়, অন্যদের উপর তার নিজের পছন্দ চাপিয়ে দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে দেখেছি। আমার নিজের ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে তিনি আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছেন, কখনও বাধা সৃষ্টি তো করেনই নি, বরং উৎসাহ যুগিয়েছেন। শৈশব থেকেই আমার মধ্যে তিনি এক ভিন্ন মানসিকতার পরিচয় পেয়েছিলেন। আমি বরাবরই আমার ভাই-বোনদের থেকে কিছুটা আলাদা ছিলাম।
আমার নিজস্ব অভ্যাস ও অচিরাচরিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মা’কে সর্বদাই ঐ বিশেষ চাহিদা মেটাতে বাড়তি উদ্যোগ নিতে হ’ত। তবে, তিনি কখনই এটাকে বোঝা হিসাবে দেখতেন না বা কখনও কোনও তিক্ততাও প্রকাশ করেননি। যেমন কিনা আমি প্রায়ই এক নাগাড়ে কয়েক মাস করে লবণ গ্রহণে বিরত থাকতাম অথবা কয়েক সপ্তাহ কোনও রকম খাদ্যশস্য গ্রহণ না করে কেবলমাত্র দুধই পান করতাম। কখনও আবার আমি ছ’মাসের জন্য মিষ্টান্ন বর্জন করতাম। শীতকালে আমি খোলা জায়গায় ঘুমাতাম এবং মাটির পাত্রে রাখা ঠান্ডা জলে স্নান করতাম। মা জানতেন যে, আমি নিজের উপর পরীক্ষা করছি আর কখনই কোনও ব্যাপারে আপত্তি করতেন না। মা বলতেন, “ঠিক আছে, তোমার যেমন ভালো লাগে তাই করো”।
আমি যে ভিন্ন পথে যাচ্ছি, মা সেটা বুঝতে পারতেন। একবার আমাদের বাড়ির খুব কাছেই অবস্থিত গিরি মহাদেব মন্দিরে এক মহাত্মা এসেছিলেন। আমি তাঁকে অত্যন্ত ভক্তিভরে সেবা করতে থাকি। সেই সময় মা তাঁর বোনের আসন্ন বিয়ে নিয়ে ভীষণ উত্তেজিৎ ছিলেন। কারণ, তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার এটাই ছিল সুযোগ। যাই হোক, যখন গোটা পরিবারই বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত, আমি তখন মাকে বললাম আমি যেত চাই না। মা কারণ জিজ্ঞেস করায় আমি মহাত্মাকে সেবা করার কথা জানালাম।
স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বোনের বিয়েতে আমি না যাওয়ায় মা অখুশি হয়েছিলেন। কিন্তু, আমার সিদ্ধান্তকে তিনি সম্মান জানিয়ে বলেছিলেন, “ঠিক আছে, যা ভালো মনে করো, তাই করো”। তবে, আমি একা কি করে বাড়ুইতে থাকবো, সে সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ ছিল। তাই, যাওয়ার আগে তিনি কয়েকদিনের জন্য খাবার ও জল খাবার ইত্যাদি রান্না করে গিয়েছিলেন, যাতে আমি অভুক্ত না থাকি।
আমি যখন বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই, আমি তাঁকে জানানোর আগেই মা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। আমি প্রায়ই বাবা-মাকে বলতাম, আমি বাইরে বেরিয়ে পড়তে চাই আর দুনিয়াটাকে বুঝতে চাই। আমি তাঁদের স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলতাম আর এও বলতাম যে আমি রামকৃষ্ণ মিশন মঠে যেতে চাই। এটা অনেকদিন ধরে চলেছিল।অবশেষে আমি গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত জানাই এবং তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করি। আমার বাবা একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন এবং বিরক্তি সহকারে বলেছিলেন, “তোমার যা অভিরুচি”। আমি তাঁদের জানাই, তাঁদের আশীর্বাদ ছাড়া আমি ঘর ছাড়বো না। মা আমার অভিপ্রায় বুঝে আশীর্বাদ করে বলেন, তোমার মন যা চায় তাই করো। আমার বাবাকে বোঝানোর জন্য তিনি আমার কোষ্ঠী কোনও জ্যোতিষিকে দেখাতে বলেছিলেন। আমার বাবা জ্যোতিষ জানা এক আত্মীয়র সঙ্গে পরামর্শ করেন। আমার কোষ্ঠী দেখে সেই আত্মীয় বলেছিলেন, “ওর পথ আলাদা। ও সেই পথেই যাবে, সর্বশক্তিমান যা ওর জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন”।
এর কয়েক ঘন্টা পর আমি গৃহত্যাগ করি। ততদিনে আমার বাবাও আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। আর আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। চলে আসার আগে, মা আমাকে দই ও গুড় খাইয়েছিলেন পবিত্র শুভারম্ভের জন্য। তিনি জানতেন যে, এরপর আমার জীবন অত্যন্ত পৃথক হয়ে পড়বে। মায়েরা তাঁদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে যতই পটু হন না কেন, যখন তাঁদের সন্তান বাড়ি ছেড়ে যায়, সেটা মেনে নেওয়াটা তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মায়ের চোখে জলে ভরে এসেছিল। কিন্তু, আমার ভবিষ্যতের জন্য প্রচুর আশীর্বাদও ছিল সেই সঙ্গে। একবার বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর আমি যেখানেই থাকি এবং যেমনই থাকি, মায়ের আশীর্বাদই ছিল আমার সঙ্গে থাকা একমাত্র ধ্রুবীয় সম্পদ। মা সর্বদাই আমার সঙ্গে গুজরাটিতে কথা বলেন। গুজরাটিতে ‘তু’ শব্দটি সমবয়সী ও ছোটদের সম্বোধনে ব্যবহার করা হয়। আমরা বয়সে বড় বা সম্মানে বড় কাউকে সম্মান করতে চাইলে ‘তমে’ ব্যবহার করি। ছোট বেলা মা আমাকে ‘তু’ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু, পরবর্তীতে আমি বাড়ি ছাড়ার পর নতুন পথে পা দেওয়ায় তিনি ‘তু’ বলা বন্ধ করেন এবং সেই থেকে তিনি আমাকে ‘তমে’ বা ‘আপ’ বলে সম্বোধন করে থাকেন।
মা আমাকে সবসময়েই গরীব কল্যাণে নজর দিতে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহিত করেছেন। আমার মনে আছে, যখন আমি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হবো বলে স্থির হ’ল, সেই সময় আমি রাজ্যে ছিলাম না। ফিরে আসার পর আমি সোজা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। মা ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং জানতে চেয়েছিলেন, আমি আবার তাঁর সঙ্গেই থাকবো কিনা। তিনি অবশ্য আমার উত্তর জানতেন। এরপর তিনি আমাকে বলেন, “সরকারের তোমার কি কাজ আমি বুঝি না, কিন্তু তুমি যেন কখনও উৎকোচ না নাও, আমি সেটাই চাই”।দিল্লিতে আসার পর তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ আগের চেয়ে অনেক কমে গিয়েছে। কখনও কখনও আমি যখন গান্ধীনগরে যাই, মায়ের সঙ্গে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা করি। আগের মতো এখন আর তত বেশিবার দেখা হয় না। কিন্তু, আমার অনুপস্থিতির জন্য কখনও আমি মায়ের দিক থেকে কোনও অসন্তোষ কখনও দেখিনি। তাঁর ভালোভাসা ও স্নেহ একই আছে, তাঁর আশীর্বাদও একই রকম আছে। মা সর্বদাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি দিল্লিতে ভালো আছো তো, আমার এটা ভালো লাগছে তো”।
মা আমাকে সবসময় এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, তাঁর সম্পর্কে দুশ্চিন্তা করে বৃহত্তর দায়িত্ব সম্পর্কে মনোযোগ খোয়ানো উচিৎ হবে না। যখনই আমি মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলি, “কারও সঙ্গেই কোনও অন্যায় বা মন্দ কিছু করো না আর গরীবদের জন্য কাজ করতে থাকো”।
আমি যদি আমার বাবা-মায়ের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সততা ও আত্মসম্মান হ’ল তাঁদের সবচেয়ে বড় গুণ। দারিদ্র্য ও তার সঙ্গী নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই সত্ত্বেও আমার পিতামাতা কখনও সততার পথ ত্যাগ করেননি বা আত্মসম্মানের সঙ্গে আপোষ করেননি। যে কোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তাঁদের একটাই মন্ত্র ছিল – কঠোর পরিশ্রম, নিরন্তর কঠোর পরিশ্রম।
সারা জীবনে বাবা কখনও কারও উপর বোঝা হয়ে থাকেননি। মাও এটাই নিশ্চিত করতে চান – তিনি এখনও নিজের কাজকর্ম যতটা সম্ভব নিজেই করেন।
এখন যখনই মায়ের সঙ্গে দেখা হয়, মা আমাকে সবসময়েই বলেন, “আমি কারও সেবা নিতে চাই না, আমার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল থাকা অবস্থাতেই আমি চলে যেতে চাই”।আমার মায়ের জীবন কাহিনীতে আমি সংযম, আত্মাত্যাগ ও ভারতের মাতৃশক্তির প্রতি অবদান দেখতে পাই। যখনই আমি মায়ের দিকে ও তাঁর মতো কোটি কোটি মহিলার দিকে দেখি, তখনই মনে হয় যে, এমন কিছু নেই, যা ভারতীয় নারীর পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়।
প্রতিটি বঞ্চনার কাহিনীর নেপথ্যেই মায়ের গৌরবজনক কাহিনী লুকিয়ে থাকে। প্রতিটি সংগ্রামের অনেক ঊর্ধ্বে থাকে মায়ের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।
মা তোমার জন্য অত্যন্ত আনন্দময় জন্মদিনের অভিনন্দন। তোমার জন্মশতবর্ষের সূচনাকালে রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা। তোমার জীবন সম্পর্কে প্রকাশ্যে বিশদে লেখার সাহস আমার এর আগে কখনও হয়নি। তোমার সুস্বাস্থ্য ও ভাল থাকার জন্য আমি সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করি আর আমাদের সকলের জন্য তোমার আশীর্বাদ চাই।
আমি তোমার চরণে প্রণাম জানাই।
২০২২ সালের ১৮ জুন মায়ের শততম জন্মদিনে নিজের ব্লগে লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী