মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী আকাশ থেকে নামবেন স্বপ্ন এবং বিকাশের ঝুলি নিয়ে।
অতিমারির ধাক্কা, সংখ্যালঘুর ক্ষোভ, বেকারি, জাতপাতের দিগন্ত জোড়া বিস্তার। তার মাঝে ‘এক ফালি’ রানওয়ে আজ ঝলমল করছে নভেম্বরের নরম রোদে। যার পোশাকি নাম সুলতানপুর জেলার ‘কুড়েভার এয়ার স্ট্রিপ’। কাল যেখানে ‘উন্নয়ন ও বিকাশের’ স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধবিমানে নামবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
উত্তরপ্রদেশের আসন্ন নির্বাচনের আগে রাজ্যবাসীকেও ওই স্বপ্নের সওয়ারি করতে আজ এক দিকে রাজ্য প্রশাসনের যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি। অন্য দিকে গুজরাত বা মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি ‘উজ্জ্বলতর উত্তরপ্রদেশ’-এর বার্তা দিতেও কোনও ত্রুটি রাখছে না যোগী আদিত্যনাথের সরকার। বিনিয়োগই হোক বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থার বিস্তার, কিংবা কড়া হাতে অপরাধ দমনের দাবি— ‘শাইনিং উত্তরপ্রদেশ’-এর মোড়ক তৈরি করে রাখছেন যোগী। কাল কিছুটা নাটকীয় ভাবে নেমে তারই ফিতে কাটবেন প্রধানমন্ত্রী।
লখনউ শহরের প্রধান রাস্তাগুলি সোমবার এলইডি আলোয় ঝলমল করছে রাতে। বড় বড় স্ক্রিনে যোগীর ভিডিয়ো দিনভর। লখনউ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে সীতাপুর জেলার বাসিন্দা সীতারাম মিশ্র। লখনউয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন তিন বছর। যোগীকে ভোট দেবেন আগের বারের মতোই। যুক্তি হিসাবে তুলে ধরছেন, গত কয়েক বছরে পরিকাঠামোর অভূতপূর্ব উন্নতি এবং আদিত্যনাথের সব ‘গোলমাল সামলে দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা’। “দেখুন না লখিমপুর খেরি নিয়ে কি গরম হল বাজার! কিন্তু যোগীজি যে ভাবে টাকা দিয়ে পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ালেন, সব ঠিক হয়ে গেল। কোভিডের সই মারাত্মক অবস্থার পর, এখন কিন্তু ওই সব নিয়ে কোনও কথা বিশেষ শুনবেন না। বিকাশ দুবেকে ‘এনকাউন্টারে ঠুকে’ দেওয়ার পরেও কি ঝামেলাই না হল যোগীর বিরুদ্ধে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সব ঝামেলা খতম!” এক কথায় যোগীর ‘সুপারম্যান’ ভাবমূর্তি ভালই বিক্রি হচ্ছে ভোটমেলায়।
আগেও এসে দেখেছি, উত্তরপ্রদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ইদানীং অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপে যেতে চান না। তাঁদের এই ত্রাস সহজবোধ্য। কিন্তু যেটা অন্য দিক, তিন তালাকের বিষয়টিকে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যেও বড় ভাবে প্রচার করছে বিজেপি। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে তার। এক, যদি মুসলমান মহিলাদের খুব সামান্য অংশকেও নিজেদের দিকে আনা যায়, অনেক নির্বাচন কেন্দ্রে এসপি-র হিসাবে গোলমাল হয়ে যেতে পারে। দুই, যে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে, তাকে খুশি করাটাও লক্ষ্য যোগীর।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব অবনীশ কুমার অওয়স্থী, উত্তরপ্রদেশ এক্সপ্রেসওয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যানও বটে। আজ মাথা তোলার সময় পাচ্ছেন না। কিন্তু এর মধ্যেই ভিন্ রাজ্যের সাংবাদিকদের জন্য সময় বার করে পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়ের দু’দিকে শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা শোনালেন। তাঁর কথায়, “এখন আর দিল্লি দূর নয়। এই এক্সপ্রেসওয়েকে কাজে লাগিয়ে অনেক কম সময়ে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের কৃষক তাঁদের পণ্য পৌঁছে দিতে পারবেন দিল্লির বাজারে। এই মহাসড়কের দু’ধারে গড়ে উঠবে হস্তশিল্প, দুগ্ধজাত শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র, মান্ডি, স্টোরেজ প্নান্ট।” প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ চিহ্নিত করছেন তাঁরা। যার মধ্যে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের প্রতিরক্ষা-বাণিজ্য করিডরও। পাশাপাশি অওয়স্থীর দাবি, “রাজ্যের গ্যাংস্টারদের ১৯ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে রাজ্য সরকার।”
তথ্য দফতরর অতিরিক্ত মুখ্যসচিব নবনীত সহগল জানাচ্ছেন, “আর রুগ্ন (বিমারু) রাজ্য নয়। দেশে এখন মহারাষ্ট্রের পরই বৃহত্তম অর্থনীতি উত্তরপ্রদেশ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিপুল কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগ হয়েছে। ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার তালিকায় আমাদের রাজ্য দেশে তিন নম্বরে, অর্থাৎ মহারাষ্ট্র আর গুজরাতের পরই। অনেক কথা সাজিয়ে বলা হয়, কিন্তু তাতে সত্যতা নেই।”
রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, ভোট এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুত্বের হাওয়া বইছে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের পালে। কিন্তু অবনীশের দাবি, “গত পাঁচ বছরে রাজ্যে একটিও সাম্প্রদায়িক অশান্তির ঘটনা ঘটেনি। মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত অপরাধীদের উদ্দেশ্যে কড়া এবং নির্মম বার্তা দিয়েছেন।” গ্যাংস্টারদের তালিকায় প্রায় একশো শতাংশ কোন ধর্মাবলম্বী, সে বিষয়টি নিয়ে অবশ্য আজ সরব হতে চাইছে না যোগী প্রশাসন।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী আকাশ থেকে নামবেন স্বপ্ন এবং বিকাশের ঝুলি নিয়ে। সোমবার তার ভিত তৈরি করাই মূল সাধনা ছিল যোগীর।