নতুন সংসদ ভবনের শিলান্যাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি পিটিআই।
বিরোধীদের আপত্তিতে কর্ণপাত না-করে, সংখ্যার জোরে তিনটি কৃষি বিলকে আইনে পরিণত করেছে মোদী সরকার। অভিযোগ উঠেছিল, সরকার গণতান্ত্রিক পথে চলছে না। এ বার কৃষক সংগঠনগুলি সেই কৃষি আইনের বিরোধিতায় আন্দোলন শুরুর পরে মোদী সরকারের এক শীর্ষকর্তা ‘অত্যধিক গণতন্ত্র’ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। প্রশ্ন উঠেছিল, মোদী সরকার কি গণতন্ত্র তুলে দিতে চাইছে?
নতুন সংসদ ভবনের শিলান্যাস করে আজ প্রধানমন্ত্রী সেই গণতন্ত্রের জয়গান গাইলেন। তাঁর বক্তব্য, গণতন্ত্র ভারতে একটি সংস্কার, জীবনের মূল্য, জীবন পদ্ধতি, জাতীয় জীবনের আত্মা। বিশ্বাসের সঙ্গে দেশের গণতন্ত্রের জয়গান করলে, গোটা দুনিয়া বলবে, ভারতই গণতন্ত্রের জননী।
শিলান্যাস ও ভূমিপুজো অনুষ্ঠানে মোটের উপর বিরোধী শিবির গরহাজিরই ছিল। লোকসভা-রাজ্যসভার সাংসদদের ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠানে হাজির থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অনুষ্ঠানের মঞ্চে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি যাননি। বিরোধীদের প্রশ্ন, এক দিকে অতিমারি, আর এক দিকে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে শীতের মধ্যে চাষিরা জাতীয় সড়কে বসে— তার মধ্যে ৯০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করে এখনই নতুন সংসদ ভবন তৈরির কী প্রয়োজন?
কংগ্রেস নেতা রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলেন, ‘‘ইতিহাসে লেখা থাকবে, যখন অন্নদাতারা ১৬ দিন ধরে রাস্তায় লড়াই করছিলেন, তখন মোদীজি সেন্ট্রাল ভিস্টার নামে নিজের জন্য মহল তৈরি করছিলেন।’’ রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য, ‘‘দেশের আসল নায়কেরা যখন নিজের জীবন-জীবিকার লড়াই করছেন, তখন এক নিরো ছবি তোলাতে ব্যস্ত।’’ সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির কটাক্ষ, ‘‘অর্থের প্রকাণ্ড অপচয় হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের মূল্য নিয়ে বক্তৃতা করছেন, কিন্তু কাজের বেলায় গণতন্ত্রকে নির্মম ভাবে ধ্বংস করে, ভিন্নমত দমন করে, মানুষকে জীবনসঙ্গী বাছতেও বাধা দিচ্ছেন।’’
কৃষি আইন নিয়ে কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের আলোচনা কার্যত অন্ধগলিতে ঢুকে গিয়েছে। কৃষক নেতারা মনে করছেন, আর আলোচনায় বসে লাভ হবে না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় পরোক্ষে কৃষক সংগঠনগুলিকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছেন। পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকদের বার্তা দিতেই গুরু নানককে উদ্ধৃত করে মোদী বলেন, ‘‘মতভেদের জায়গা থাকবে, কিন্তু যোগাযোগ থাকবে, এই লক্ষ্য নিয়েই গণতন্ত্র এগিয়েছে। গুরু নানক বলেছিলেন, যত দিন সংসার, তত দিন কথা চালিয়ে যেতে হবে।’’
শিলান্যাসের সঙ্গে আজ ভূমিপুজোও করেন প্রধানমন্ত্রী। কর্নাটকের শৃঙ্গেরী মঠের ছ’জন পুরোহিতের মন্ত্রোচারণের সঙ্গে প্রথমে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ যাতে নির্বিঘ্নে হয়, সে জন্য হয় গণেশ-প্রার্থনা। পরে ক্ষেত্রপাল, ভূমাতা, অনন্ত আদিশেষ, কূর্ম ও বরাহরূপী বিষ্ণুর প্রার্থনা করা হয়। এর পর নবগ্রহের প্রার্থনা করে নবরত্ন খচিত আধারশিলা স্থাপন। শেষে স্থাপন করা হয় নবধান্য, নবরত্ন ও পঞ্চধাতুর কলস। শিলান্যাসের সঙ্গে কেন হিন্দু মতে ভূমিপুজো হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ভূমিপুজোর পরে সব ধর্মের প্রার্থনা সভা হয়। বিরোধীরা বলছেন, এখানেই দেশে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছ’জন হিন্দু ধর্মগুরু। অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুরা দূরে।
নয়া ভবন নির্মাণের বরাত পেয়েছে টাটা প্রজেক্ট। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এখনই নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে না। শিলান্যাস অনুষ্ঠানে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান এমিরেটাস রতন টাটা বলেন, ‘‘এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হিসেবে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি ধন্য।’’
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু ছিল, তার উদাহরণও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু জয়রাম রমেশ, মণীশ তিওয়ারির মতো কংগ্রেস সাংসদেরা নতুন সংসদ ভবনের নকশার সঙ্গে পেন্টাগনের মিল খুঁজে পেয়েছেন। জয়রামের কথায়, ‘‘ব্রিটিশদের তৈরি সংসদ ভবনের সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের মোরেনার চৌষঠ যোগিনী মন্দিরের মিল ছিল। আত্মনির্ভর সংসদ ভবনের সঙ্গে ওয়াশিংটনের পেন্টাগনের মিল।’’ তিওয়ারির প্রশ্ন, ‘‘এটা কি সমাপতন, ইচ্ছাকৃত নাকি স্বতঃপ্রণোদিত?’’