ভারত-মার্কিন বাণিজ্য পরিষদের সামনে বুধবার ভিডিয়ো বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।—ছবি পিটিআই।
করোনার তাণ্ডবে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত। হাত গুটিয়ে বিনিয়োগকারীরা। প্রায় সমস্ত সমীক্ষা অনুযায়ী, চলতি অর্থবর্ষে প্রায় ৫% সঙ্কোচনের মুখে ভারতের অর্থনীতি। কিন্তু পালের উল্টো দিকে বইতে থাকা এমন প্রবল হাওয়ায় দাঁড়িয়েও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দাবি, ভারতে টাকা ঢালার এমন সুযোগ আর সুসময় মার্কিন লগ্নিকারীদের সামনে আগে কখনও আসেনি।
ভারত-মার্কিন বাণিজ্য পরিষদের সামনে বুধবার ভিডিয়ো বক্তৃতায় ভারতকে লগ্নিতে দুনিয়ার পয়লা নম্বর পছন্দের গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন মোদী। কৃষি, বিদ্যুৎ, বিমান পরিবহণ, পরিকাঠামো, বিমা, প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে মহাকাশ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রের নাম করে বলেছেন, কী বিপুল বাজার আর বিনিয়োগের সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে সেখানে। ঠিক যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজ রাজ্যের শিল্প সম্মেলন ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের’ মঞ্চে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন তিনি, আজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনেকটা সেই ভূমিকাতেই দেখা গেল তাঁকে। কিন্তু অর্থনীতি-বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, গুজরাতের জন্য বড় লগ্নি টানার যে ট্র্যাক রেকর্ড মুখ্যমন্ত্রী মোদীর ছিল, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখনও পর্যন্ত তেমন সাফল্য ঝুলিতে পুরতে পারেননি তিনি। তার উপরে করোনার আগেই ঝিমিয়ে থাকা দেশের অর্থনীতি অতিমারির ছোবলে কার্যত আইসিইউয়ে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন লগ্নিকারীরা হঠাৎ কেন এ দেশে বিপুল অঙ্কের পুঁজি ঢালতে উৎসাহ দেখাবেন, তার উত্তর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট নয় বলে তাঁদের দাবি।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ দেশের মতো খোলা ও বিপুল বাজারের জুড়ি দুনিয়ায় মেলা ভার। পাওয়া কঠিন এমন সুযোগের সম্ভারও। তা সে প্রতিরক্ষায় বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি হোক বা পরিকাঠামোয় প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা লগ্নির প্রয়োজনিয়তা। ভারত-আমেরিকার যুগলবন্দিই করোনায় মুখ থুবড়ে পড়া বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারবে বলে তাঁর দাবি। সেই সুযোগে তিনি আমেরিকাকে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, “সেই দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য বাড়ুক, যাকে বিশ্বাস করা যায়।”
আরও পড়ুন: সুপার স্প্রেডারদের খুঁজেই সংক্রমণে রাশ রাজধানীতে
কিন্তু বাণিজ্য আর বন্ধুত্বের হাতই বা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ সে ভাবে বাড়াল কোথায়? হালে চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতের পরে কিছু ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনকে পাশে পেয়েছে দিল্লি। মার্কিন বিদেশসচিব মাইক পম্পেয়ো বলেছেন, বাণিজ্য বৃদ্ধির কথা। কিন্তু কিছু দিন আগে পর্যন্তও বিভিন্ন মার্কিন পণ্যের উপরে চড়া আমদানি শুল্কের জন্য মোদীকে বিঁধতে ছাড়েননি ট্রাম্প।
শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল সম্প্রতি দাবি করেছেন, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে ভারত। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, ভারত চায় এ দেশে তৈরি জেনেরিক ওষুধের জন্য মার্কিন বাজার হাট করে খুলে দিক ওয়াশিংটন। তৈরি হোক এমন বেশ কিছু পণ্যের তালিকা, যা ভারত থেকে আমদানির সময়ে শুল্ক বসাবে না আমেরিকা। তেমনই উল্টো দিকে, ভারতের কৃষিপণ্যের বাজারে আরও বেশি দখল চায় আমেরিকা। নিশানা এ দেশের দুগ্ধজাত পণ্যের বাজারও। কিন্তু সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন, চিনা পণ্যে বাজার ছেয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশীয় কৃষক এবং গোয়ালাদের ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কাতেই ১৬ দেশের প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (আরসিইপি) থেকে সরে এসেছিলেন মোদী। এখন আমেরিকার শর্ত মানবেন কী যুক্তিতে? সঙ্ঘ ও স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ কি তা মেনে নেবে?
আরও পড়ুন: গোষ্ঠী সংক্রমণে কেন্দ্রের ‘আপত্তি’র পিছনে দুই অঙ্ক
সম্প্রতি নতুন করে এইচ-১বি ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে আমেরিকা। ফি বছর যার প্রায় ৭০% যায় ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের পকেটে। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আজ এই একই মঞ্চে বলেছেন, “ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শুধু বাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লায় মাপলে চলবে না। বরং সময় এসেছে আরও বেশি করে জ্ঞান এবং উদ্ভাবনের সংযোগ স্থাপনের।” মার্কিন অর্থনীতিতে প্রায় ৪০ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও অনাবাসী ভারতীয়ের অবদানের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন জয়শঙ্কর। অর্থাৎ, তার পরেও ভিসায় কাটছাঁট ভারতের প্রতি সুবিচার কি না, সেই প্রশ্নটা তুলে ধরেছেন, সরাসরি না বলেও। প্রশ্ন উঠছে, এ বিষয়ে উদ্বেগের কথাই বা এ দিন মোদী শিল্পমহলের প্রতিনিধিদের সামনে তুললেন কোথায়?
লগ্নির জমি হিসেবে ভারত কতটাই লোভনীয়, তা বোঝাতে মোদী এ দিন বলেছেন, এই মুহূর্তে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ কোটি। শহরের থেকে গ্রামে বেশি। ৫জি প্রযুক্তি আসছে। নেট-সংযোগে জুড়তে চলেছেন আরও ৫০ কোটি মানুষ। গোটা বিশ্বে এমন বিপুল বাজার আর কোথায় মিলবে? কখনও হালকা ঠাট্টার ছলে বলেছেন, কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই এত সুযোগের কথা বলে দিলেন তিনি। দাবি করেছেন, করোনার মধ্যেও এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে বিদেশি লগ্নি এসেছে ২০০০ কোটি ডলার।
বিরোধীদের প্রশ্ন, ওই বিনিয়োগ তো মূলত এসেছে বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারে। নতুন করে কল-কারখানা কিংবা কাজের সুযোগ তৈরির মতো বিদেশি লগ্নি কোথায়? কংগ্রেসের কটাক্ষ, নোটবন্দি, করোনা সব কিছু সামলাতেই মোদী সময় চান। এ বার সেই অপেক্ষায় লাটে ওঠার জোগাড় অর্থনীতির। তা সত্ত্বেও স্বপ্ন ফেরি করে সকলকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন তিনি।