নীতীশকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর টুইট। পিটিআইয়ের তোলা ফাইল চিত্র।
অত্যন্ত দ্রুত আমূল বদলে গেল ছবিটা। বুধবার বিকেল পর্যন্তও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছিলেন, চাপে নীতীশ কুমার। এক দিকে তিনি ‘সুশাসন’-এর অঙ্গীকার থেকে পিছিয়ে আসতে পারবেন না। অন্য দিকে, জোটধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে এ বার তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে খুব বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হবে। নীতীশ ‘সুশাসন’-এই অটল রইলেন। আবার জোট ভাঙার দায়ও নিজের ঘাড়ে নিলেন না। তেজস্বীকে বরখাস্ত না করে নিজেই ছেড়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রিত্ব। দিল্লি যে এমন কোনও খবরের অপেক্ষাতেই ছিল, তা স্পষ্ট। নীতীশের ইস্তফার খবর রাজভবনের বাইরে আসার মিনিট পনেরোর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর টুইট, ‘‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া লড়াইয়ে যোগদানের জন্য নীতীশ কুমারজিকে অভিনন্দন।’’
বিহার বিজেপি গতকাল পর্যন্তও নীতীশ কুমারকে নিয়ে রাশি রাশি প্রশ্ন তুলছিল। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখ তথা নীতীশ মন্ত্রিসভার এককালের উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদী ‘সুশাসন বাবু’ বলে নীতীশকে কটাক্ষ করছিলেন। নীতীশ যে ‘সুশাসন’-এর প্রতিশ্রুতিতে অটল, তা প্রমাণ করতে সরকারের মায়া ত্যাগ করে তেজস্বীকে বরখাস্ত করার সাহস দেখানো দরকার, বলছিল বিহার বিজেপি। বুধবার সন্ধ্যায় সকলকে চমকে দিয়ে নীতীশ মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিতেই আপাদমস্তক বদলে গিয়েছে বিজেপির সুর। নীতীশের ইস্তফার খবর পেয়েই কেন্দ্রীয়মন্ত্রী তথা বিহার বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ বিবৃতি দেন। নীতীশের এই পদক্ষেপের প্রতি বিহার বিজেপির পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে তিনি জানিয়ে দেন।
নরেন্দ্র মোদীর টুইটটি সামনে আসার পর আরও স্পষ্ট হয়ে যায় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ। নীতীশের এই সিদ্ধান্তকে শুধুমাত্র ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই’ আখ্যা দিয়েই থামেননি প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘১২৫ কোটি নাগরিক সততাকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং সমর্থন করছে।’’
এর পর ফের একটি টুইট করেন মোদী। দ্বিতীয় টুইটে নীতীশের নাম করেননি। কিন্তু বিহারে জেডি (ইউ)-বিজেপি সরকার গঠনের প্রস্তাব বেশ স্পষ্ট করেই দিয়ে দেন। রাত ৯টা নাগাদ সুশীল মোদী জানিয়ে দেন, নীতীশ কুমারকে সমর্থন করতে প্রস্তুত বিজেপি। নীতীশকে সে কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও সুশীল মোদী জানান।
ইস্তফা দেওয়ার পর রাজ ভবন থেকে বেরিয়ে নীতীশ কুমার। ছবি: পিটিআই।
মহাজোটের বাকি দুই শরিক আরজেডি আর কংগ্রেস কিন্তু মনে করছে, আচমকা কোনও কিছুই হয়নি। বিজেপির সঙ্গে নীতীশের গোপন কথাবার্তা অনেক দিন ধরেই চলছিল বলে এই দুই দল দাবি করছে। মহাজোট ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলালে বিজেপি যে মুখ্যমন্ত্রী পদে নীতীশকেই সমর্থন করবে, সে বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরেই নীতীশ ইস্তফা দিয়েছেন বলে পটনায় জল্পনা। নীতীশের ইস্তফার পর লালু যে সাংবাদিক বৈঠক করেন, সেখানে তিনি বেশ স্পষ্ট করেই নীতীশ-বিজেপি আঁতাতের ইঙ্গিত দেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষিত হওয়ার পরই রামনাথ কোবিন্দ বিহারের রাজ্যপাল পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। অস্থায়ী ভাবে বিহারের রাজ্যপাল হিসেবে কাজ চালাচ্ছেন বাংলার রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি। এ দিন নীতীশ কুমার রাজভবনে যেতে পারেন এবং ইস্তফা দিতে পারেন, তা আগে থেকে কেউই জানতেন না। কিন্তু ঘটনাচক্রে কেশরীনাথ ত্রিপাঠি এ দিন পটনার রাজভবনেই ছিলেন। রাজ্যপালের এই উপস্থিতিকেও ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছেন আরজেডি নেতারা।
আরও পড়ুন: বিহারে জোট সরকার ভেঙে দিয়ে ইস্তফা নীতীশের
বিহার বিধানসভার ছবিটা এই মুহূর্তে যে রকম, তাতে বিজেপি আর জেডি (ইউ) হাত মেলালে অনায়াসে সরকার গঠন করা সম্ভব। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় ১২২ জন বিধায়ক সঙ্গে থাকলেই সরকার গড়া যায়। বৃহত্তম দল লালুর আরজেডি। তাদের রয়েছে ৮০টি আসন। দ্বিতীয় বৃহত্তম নীতীশের জেডি (ইউ)। তাদের রয়েছে ৭১টি আসন। তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি। আসন সংখ্যা ৫৬। আর চতুর্থ স্থানে কংগ্রেস। ২৭টি আসন রয়েছে কংগ্রেসের। বিজেপির তিন জোটসঙ্গী এলজেপি, আরএলএসপি এবং এইচএএম-এর হাতে রয়েছে মোট ৫টি আসন। অর্থাৎ, ১৭৮ বিধায়কের মহাজোট (লালু-নীতীশ-কংগ্রেস) ছেড়ে বেরিয়ে এসে নীতীশ যদি বিজেপি তথা এনডিএ-র হাত ধরেন, তা হলে জেডি(ইউ)-এর ৭১ জন এবং এনডিএ-র ৫৮ জন মিলে মোট ১২৯ জন বিধায়কের সমর্থন থাকবে নীতীশের সঙ্গে। ম্যাজিক ফিগারের চেয়ে ৭টি বেশি।
তেমন কোনও ছবিই কি তৈরি হতে চলেছে পটনায়? নীতীশের ইস্তফা, তড়িঘড়ি রবিশঙ্কর প্রসাদের বিবৃতি এবং ততোধিক দ্রুততায় নরেন্দ্র মোদীর টুইট— ছবিটা খুব তাড়াতাড়িই স্পষ্ট হচ্ছিল পটনায়। তার পর সুশীল মোদী যখন নীতীশকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করলেন, তখন আরও পরিষ্কার হয়ে গেল ছবিটা। কিন্তু বিজেপির সমর্থন নিয়ে তিনি সরকার গড়বেন কি না, নীতীশ কুমার এখনও সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। জেডি (ইউ)-এর তরফেও মুখ খোলা হয়নি।