ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) বার্ষিক অধিবেশনে বক্তব্য রাখছেন নরেন্দ্র মোদী।—ছবি পিটিআই।
‘চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী, পায়ের বেগেই পথ কেটে যায়, করিস নে আর দেরি’।
শুরু করেছিলেন, ‘নমস্কার! আশা করি আপনারা সবাই ভাল আছেন!’ বলে। আর শেষ করলেন হিন্দি টানে হলেও বাংলাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ওরে, নূতন যুগের ভোরে’ আবৃত্তি করে। তার মাঝখানে আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কলকাতার শিল্পমহলকে কলকাতা তথা বাংলার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখালেন। ২০২১ বিধানসভা ভোটের আগে একে শিল্পমহলের উদ্দেশে মোদীর রাজনৈতিক বার্তা হিসেবেই দেখছেন শিল্পপতি তথা রাজনীতিকরা।
কলকাতার বণিকসভা ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) বার্ষিক অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বৃহস্পতিবার মোদী জানান, তাঁর সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত লাভবান হবে। মোদীর কথায়, ‘‘আমি মনে করি, কলকাতা নিজে আবার বিরাট বড় নেতৃত্ব দিতে পারে। নিজের পুরনো গৌরব থেকে প্রেরণা নিয়ে, ভবিষ্যতে কলকাতা দেশের এই অঞ্চলের নেতৃত্ব দিতে পারে।’’ শিল্পপতিদের তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের থেকে ভাল আর কে জানে যে, সম্পত্তি পূর্বের, কাঁচামাল পূর্বের, শ্রমিকরাও পূর্ব ভারতের। তা হলে এই ক্ষেত্রের উন্নতি কতটা দ্রুত গতিতে হতে পারে!’’
বাংলার শিল্প নিয়ে মোদীর বক্তব্যের সরাসরি সমালোচনা না করলেও রাজ্যে শাসক তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিনও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন। শিল্প নিয়ে মোদীর বক্তব্যের সমালোচনা করে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘সারা দেশের বারোটা বাজিয়ে এখন বাংলার জন্য সমৃদ্ধির গল্প শোনাতে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী! সারা দেশের গল্প আজকে শেষ। না শিল্প-বাণিজ্য, না কোনও রফতানি, না উৎপাদন— কোনও কিছু নেই।’’
গত ন’বছরে বাংলায় উন্নয়নে জোয়ার এসেছে বলে রাজ্য দাবি করলেও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ গত মঙ্গলবার বলেছিলেন, সিন্ডিকেট-তোলাবাজি ও বোমা কারখানা ছাড়া রাজ্যে কিছু হয়নি। তাঁরা ক্ষমতায় এলে ‘সোনার বাংলা’ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শাহ। আজ রাজনীতির প্রসঙ্গ এড়ালেও অনেকটা অমিতের সুরেই মোদী বলেন, ‘‘উৎপাদনমুখী শিল্পে বাংলার ঐতিহ্যের দৃষ্টান্তের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে।’’ আবেগ উস্কে দিতে তিনি বলেন, ‘‘আমরা বরাবরই শুনি, বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত তা কাল ভাবে। এর থেকে প্রেরণা নিয়েই এগোতে হবে।’’
কলকাতার শিল্পপতিদের সামনে করোনা পরিস্থিতি ও তা থেকে বেরোতে কেন্দ্রের নানা ভাবনা ও পরিকল্পনা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। মোদীর মতে, উৎপাদনমুখী শিল্প ছাড়াও জৈব সার, পাটচাষ-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নীতির ফলে পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল লাভবান হবে। তখন নেতৃত্ব দেবে কলকাতা তথা বাংলা। যেমন, এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জনের কেন্দ্রীয় নীতির ফলে বঙ্গের পাটশিল্প লাভবান হতে পারে। মোদীর এই বক্তব্য খারিজ করে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পাট শিল্পের উন্নতিতে এত দিন কেন্দ্র প্রয়োজনীয় সাহায্য করেনি। এখন পাট বা জৈব চাষে কেন্দ্রকেই নীতি নিতে হবে।’’
তাঁর আমলে জলপথ পরিবহণে জোর দিয়ে পণ্য পরিবহণের খরচ কমেছে দাবি করে মোদী বলেন, জলপথ পরিবহণের সেই সূত্রেই জুড়েছে হলদিয়া ও বারাণসী। এর পরে উত্তর-পূর্বেও জলপথ পরিবহণের বিস্তার ঘটবে। মোদীর সহাস্য মন্তব্য, ‘‘বারাণসীর সাংসদ হিসেবে কলকাতার সঙ্গে আমার সংযোগের অভ্যাসও তৈরি হয়েছে।’’ আত্মনির্ভর হওয়া প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দকে উদ্ধৃত করেন তিনি।
করোনা-সঙ্কট ও লকডাউন থেকে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিশ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ও আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের ঘোষণার পরে প্রথমে বণিকসভা সিআইআই-এর জাতীয় পর্ষদের সভায় যোগ দিয়েছিলেন মোদী। তার পরেই আইসিসি-র ৯৫তম বার্ষিক অধিবেশনে তাঁর যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ২০২১-এর ভোটের আগে তিনি বাংলাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন। আইসিসি কর্তাদের বক্তব্য, চন্দ্রশেখরের পরে এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বার্ষিক সভায় এলেন।
অধিবেশনের পরে মোদীকে ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা’ বলে উল্লেখ করে আইসিসি-র প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব গোয়েন্কা বলেন, ‘‘আমরাও পারব, এই বিশ্বাস আপনি দিয়েছেন। আমরা আজ বলছি, আমরা পারব।’’ আইসিসি-র প্রেসিডেন্ট ময়াঙ্ক জালান বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে পরিকাঠামো ও আর্থিক উন্নয়নে পূর্ব ভারত বিপুল অগ্রগতি করেছে। করোনা তাতে সাময়িক বাধা ফেলেছে। শীঘ্রই তার পুনরুজ্জীবন ঘটবে এবং আমাদের স্বপ্ন— আত্মনির্ভর ভারত গড়ে উঠবে।’’