অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মাইনে বাড়াতে হবে দ্বিগুণ। ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় বিনামূল্যে নিয়ে যেতে দিতে হবে এক জন সঙ্গীকে।
সংসদের খাবারের জন্য সরকারি ভর্তুকি নিয়ে হইচইয়ের মেয়াদ এখনও পক্ষকালও গড়ায়নি। তারই মধ্যে সাংসদদের নিয়ে আরও একটি নতুন বিতর্ক উঁকি দিল রাজধানীর অলিন্দে। এ বারের বিষয় সাংসদদের বেতনবৃদ্ধি। সাংসদদের দাবি, দশ বা বিশ নয়, এক ধাক্কায় বেতন বাড়াতে হবে একশো শতাংশ। পাশাপাশি প্রাক্তন সাংসদদের পেনশন ৭৫ শতাংশ বাড়ানো-সহ বিভিন্ন দাবিতে সরব তাঁরা।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এই একশো শতাংশ বেতনবৃদ্ধির দাবি খাপ খাচ্ছে না বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আবার ‘পেটে খিদে মুখে লাজ’ মনোভাবও অনেকের। ঘরোয়া ভাবে (নাম করতে নারাজ ভুল বার্তা যাওয়ার ভয়ে) অনেক সাংসদই জানাচ্ছেন, এই অগ্নিমূল্যের বাজারে সাংসদদের বর্তমান বেতন (মাসে ৫০ হাজার টাকা) নামমাত্র। পরিবার নিয়ে দিল্লির মতো ‘খরুচে’ শহরে থাকতে গেলে এই টাকায় মাসের তিন সপ্তাহও গড়ায় না। অভিযোগ, অনেক পদস্থ আমলার বেতনই এর চেয়ে বেশি।
সাংসদ প্রতি বছরে খরচ ৩২ লাখ টাকা
মাসে ২.৬৬ লাখ টাকা
বেতন ১২ হাজার টাকা
এক্সপেন্স ফর কনস্টিটিয়েন্সেস ১০ হাজার টাকা
অফিস খরচ ১৪ হাজার টাকা
যাতায়াত খরচ কিলোমিটার প্রতি ৮টাকা
অধিবেশন চলাকালীন ডিএ/টিএ দিন প্রতি ৫০০ টাকা
ট্রেনে প্রথম শ্রেণিতে যাতায়াত বিনামূল্যে
বিমানে বিজনেস ক্লাসে স্ত্রী অথবা ব্যক্তিগত সচিব-সহ ৪০ বার যাতায়াত বিনামূল্যে
দিল্লিতে থাকা বিনামূল্যে
৫০ হাজার ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুত্ বিনামূল্যে
টেলিফোনে ১ লাখ ৭০ হাজার কল বিনামূল্যে
‘জয়েন্ট কমিটি অন স্যালারি অ্যান্ড অ্যালাওয়েন্স অফ মেম্বার অফ পার্লামেন্ট’-এর পক্ষ থেকে সম্প্রতি সরকারকে যে ৬০ দফা সুপারিশপত্র দেওয়া হয়েছে তাতে বেতনবৃদ্ধির পাশাপাশি একটি সার্বিক বেতন হার পর্যালোচনার কথাও বলা হয়েছে। একটি সূত্রের বক্তব্য, ‘‘সেই ২০১০ সালের পর আর বেতন বাড়েনি সাংসদদের। তাঁরা সরকারি কর্মচারীদের মতো ডিএ-ও পান না।’’ গত পাঁচ বছরে বাজারে আগুন লেগেছে বলেও মন্তব্য করছেন কমিটির অনেক সদস্যই। বিজেপি সাংসদ যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন এই কমিটির পক্ষ থেকে যে সুপারিশ করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে প্রাক্তন সাংসদকেও দেশের মধ্যে ২০ থেকে ২৫টি বিনামূল্যে বিমানযাত্রার কোটা দিতে হবে। তা ছাড়া বর্তমান সাংসদদের এক জন সফরসঙ্গীকে প্রথম শ্রেণির রেল টিকিট দেওয়া, দৈনিক ভাতা বাড়ানো (বর্তমানে যা ২০০০ টাকা), ছেলেমেয়ে এবং নাতি-নাতনিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করার মতো বিষয়গুলিও রয়েছে।
তৃণমূলের লোকসভার নেতা তথা এই সংসদীয় বেতন কমিটির অন্যতম সদস্য সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘‘এই দাবি দীর্ঘ দিন ধরেই রয়েছে যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সচিব পদের বেতন এবং এক জন সাংসদের বেতনের মধ্যে ফারাক থাকা উচিত নয়। প্রোটোকল অনুযায়ী এক জন সাংসদ এক জন সচিবের থেকে উচ্চপদমর্যাদা সম্পন্ন। মন্ত্রিসভার সচিবের বেতন বর্তমানে মাসে ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু এক জন সাংসদের যা ৫০ হাজার।’’ এই কমিটিরই আর এক সদস্য বিজেপি সাংসদ সি পি ঠাকুর খোলাখুলিই বলছেন, ‘‘সাংসদদেরও দায়দায়িত্ব থাকে। তাঁরা প্রথম শ্রেণিতে রেলসফর করলে সঙ্গে কাউকে নিতে পারেন না। এটা সমস্যার।’’ তাঁর মতে, ‘‘দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। বর্তমান মাইনেতে চালানো শক্ত।’’ অন্য দিকে সিপিআইয়ের প্রাক্তন সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত বলছেন, ‘‘মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু যতটা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে তা বড্ড বাড়াবাড়ি। মনে রাখতে হবে দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। আমাদের দেশও আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে। ফলে যে ভাবে বেতন বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে তা দেশের অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’’
কিন্তু বেশি বেতন হাতে এলে কি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে দেশের অবস্থার কথা ভেবে? এমন নেতাও কেউ রয়েছেন কি? তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও ব্রায়েন জানাচ্ছেন, ‘‘আমাদের নেত্রী কখনও কোনও সরকারি পদের বেতন নেন না। এটা আমাদের সামনে একটা পথনির্দেশিকার মতো।’’ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ অনুসরণ করে সাংসদেরাও বেতন নেন না এমনটা নয়। ফলে বর্ধিত বেতন পেলে কি ডেরেক নেবেন না? বিষয়টি স্পষ্ট না করে ডেরেকের জবাব, ‘‘বিষয়টি এখনও প্রস্তাবের পর্যায়ে রয়েছে। কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। ফলে এখনও কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’