জিৎ সিংহ
শুরুতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চেষ্টা হয়েছিল ধামাচাপা দেওয়ার। কিন্তু বিএসএফ জওয়ান তেজবাহাদুর যাদবের পরে সিআরপি জওয়ান জিৎ সিংহের ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। আধাসেনার সার্বিক উন্নতির জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলেছে নরেন্দ্র মোদীর দফতর।
খাবার নিয়ে অভিযোগ তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও পোস্ট করেছিলেন বিএসএফ জওয়ান তেজবাহাদুর যাদব। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আনলেও খাবারে যে কিছুটা গলদ আছে তা গত কালই মেনে নিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কিন্তু সিআরপিএফের জওয়ান জিৎ সিংহ আরও অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভারতীয় সেনার জওয়ানরা পেনশন, ক্যান্টিন ও বিনামূল্যে চিকিৎসার সুবিধে পান। তাঁদের জন্য রয়েছে অবসরকালীন নানা সুযোগ। আমাদের পেনশন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অন্য সুবিধেগুলিও নেই। অথচ আমরাও একই কাজ করি।’’ কুড়ি বছরের চাকরির শেষে আধাসেনার জওয়ানদের ভবিষ্যত কী তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। বিএসএফের তেজবাহাদুরের মতো সিআরপিএফে জওয়ানের ভিডিওটিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। মাথাচাড়া দিয়েছে সেনা ও আধাসেনার মধ্যে বৈষম্যের পুরনো অভিযোগ।
ভারতীয় সেনার দাবি, তারাই হল সীমান্তের ‘ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স’। কিন্তু বাস্তবে দেশের সীমান্তের অনেকটাই রক্ষা করে আধাসামরিক বাহিনী। রাজস্থান, জম্মু, গুজরাতের পাকিস্তান এবং পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে থাকে বিএসএফ। তেমনি লাদাখে চিন সীমান্ত পাহারা দেয় আইটিবিপি। আধাসেনার দীর্ঘ দিনের অভিযোগ, সেনাবাহিনীর তারাও প্রতিরক্ষার প্রথম স্তর। কিন্তু তাদের সেনার সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না। প্রশিক্ষণ, আধুনিক হাতিয়ার দেওয়ার প্রশ্নে বৈষম্য রয়েছে। কিছু এলাকায় সেনা ও আধাসেনা যৌথ ভাবে সক্রিয়। সেখানে সেনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আধাসেনার জওয়ানদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ, নিচু নজরে দেখার অভিযোগও নতুন নয়। এ সব নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই ক্ষোভ জমছে আধাসেনার জওয়ানদের মধ্যে।
সেনা ও আধাসেনার বেতন কাঠামোয় বিস্তর পার্থক্য। আধাসেনার অভিযোগ, সপ্তম বেতন কমিশন চালু হওয়ার পরে সেনারা বেশি বেতন পাচ্ছেন। এক পদ এক পেনশন নীতির ফলে তাঁদের অবসরকালীন আর্থিক সুযোগ-সুবিধেও বেড়েছে। তুলনায় আধাসেনার বেতন এমনিতেই অনেকটাই কম। ২০০৪ সাল থেকে চালু হওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের স্বেচ্ছামূলক পেনশন প্রকল্পের আওতায় এসেছে আধাসেনা। কিন্তু তারাও সেনার মতো এক পদ এক পেনশন চায়।
বেতন কাঠামো প্রশ্নে যে আধাসেনার মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন সিআরপিএফের ডিজি দুর্গাপ্রসাদ। জিৎ সিংহের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্য, ‘‘বেতন কাঠামোর বিষয়টি নিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছি। এ নিয়ে সপ্তম বেতন কমিশনের সঙ্গেও কথা হয়েছে।’’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, আধাসেনার বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে সপ্তম বেতন কমিশন।
আধাসেনা বা সেনার জওয়ানদের একটি বড় অংশের কর্মজীবন কুড়ি বছরের পরে শেষ হয়ে যায়। আধাসেনার অভিযোগ, পুনর্নিয়োগের প্রশ্নে সেনাবাহিনী অনেক বেশি সক্রিয়। অবসরের পরে কাজ পাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া সেনা জওয়ানদের একটি বড় অংশকে ফি বছর পুনর্নিয়োগ করে ‘ডিফেন্স সিকিউরিটি কোর’। কিন্তু আধাসেনার ক্ষেত্রে তেমন কোনও সুবিধে নেই। এই অভিযোগও স্বীকার করে নিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত আধাসেনাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে দক্ষতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত মন্ত্রকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। চিকিৎসা পরিষেবা বা ডিফেন্স ক্যান্টিনে সেনা জওয়ানরা প্রচুর ছাড় ও সুবিধে পান। কিন্তু আধাসেনারা সেই তুলনায় কিছুই পান না বলে অভিযোগ।
তেজবাহাদুরের মানসিক অস্থিরতা রয়েছে বলে দাবি করেছে বিএসএফ। জবাবে তাঁর স্ত্রী শর্মিলা বলেছেন, ‘‘তাহলে তাঁকে বন্দুক হাতে সীমান্তে পাঠানো হল কেন?’’ এই জওয়ানদের অভিযোগের পিছনে যে আধাসেনার গোটা নিচু স্তর, এমনকী দেশের মানুষের বড় অংশের সমর্থন রয়েছে তা বুঝতে পারছে কেন্দ্রও। তাই পরিস্থিতি সামলাতে দ্রুত রিপোর্ট চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।