সিএএ-এনআরসির প্রতিবাদে দিল্লিতে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের পর থেকে ১৩৭ দিন ইন্টারনেট বন্ধ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর দাবি, কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। অসমে গত ৮ দিন ধরে মোবাইলের ইন্টারনেট বন্ধ। রাজ্য প্রশাসনের দাবি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
সেই ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতি এ বার দেশের রাজধানীতে।
আজ দিল্লিতে বিনামূল্যে ওয়াইফাই পরিষেবা চালু করার কথা ছিল অরবিন্দ কেজরীবাল সরকারের। আর আজই সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত পুরনো দিল্লি সংলগ্ন উত্তর ও সেন্ট্রাল দিল্লি, মান্ডি হাউস, পূর্ব দিল্লির সীলমপুর, জাফরাবাদ, মুস্তাফাবাদ, দক্ষিণের জামিয়ানগর, শাহিনবাগ ও বাবনাতে সব রকম মোবাইল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হল। ইন্টারনেট তো বটেই। এমনকি মোবাইলে কথাবার্তা, এসএমএস-ও। উদ্দেশ্য, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখা। রাজধানীতে মোবাইল পরিষেবা বন্ধ রাখার নজির সাম্প্রতিক অতীতে নেই।
মোবাইল-ইন্টারনেট বন্ধ করেও অবশ্য প্রতিবাদ-বিক্ষোভ থামানো যায়নি। উল্টে যন্তরমন্তরে স্লোগান উঠেছে, ‘শাট ডাউন ফ্যাসিজম, নট ইন্টারনেট।’ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘ইন্টারনেট কেন বন্ধ করা হল? দিল্লির সব বাসিন্দা কি শহুরে নকশাল?’’ নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করে বিজেপি তথা মোদী সরকার হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের খেলায় নেমেছে বলে অভিযোগ। আজ তার বিরুদ্ধে দিল্লির ছাত্রছাত্রীরা পোস্টার লিখেছেন, ‘যব হিন্দু-মুসলিম রাজি, তো কেয়া করেগা নাৎসি!’
বাম দলগুলি আজ সারা দেশে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল। তাকে কেন্দ্র করেই যন্তরমন্তরে এখনও পর্যন্ত সব থেকে বড় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হল। যাতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগ দিলেন শিক্ষক, বিদ্বজ্জন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও। কনকনে ঠান্ডায় রাত পর্যন্ত কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী গলা মিলিয়ে ‘সারে জঁহা সে অচ্ছা’ গাইল। বারবার ফিরে এল, ‘মজহব নহি সিখাতা, আপস মে বৈর রখনা’।
রাজধানীর বুকে এই প্রতিবাদ ধামাচাপা দিতে দিল্লি পুলিশ জামিয়া মিলিয়ার মতো লাঠি চালায়নি। বরং ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে গোলাপ এগিয়ে দিয়ে স্লোগান তুলেছেন, ‘দিল্লি পুলিশ বাত করো, আও হমারে সাথ চলো।’ কিন্তু বিক্ষোভ কর্মসূচিতে রাশ টানতে গিয়ে পুলিশ হেনস্থার মুখে ফেলেছে সাধারণ মানুষকে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ১৮টি মেট্রো স্টেশন।
শহরের বাইরের লোক যাতে প্রতিবাদে যোগ দিতে না পারেন, গুরুগ্রাম ও নয়ডা থেকে দিল্লিতে ঢোকার হাইওয়েতে গাড়ি প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ ‘গ্রিডলক’ বসায়। তাতে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। ওই রাস্তাতে দিল্লির বিমানবন্দর। যাত্রীদের সঙ্গে আটকে পড়েন বিমানের পাইলট, কর্মীরাও। ইন্ডিগো-র ১৯টি বিমান বাতিল হয়। আরও ১৬টি বিমান দেরিতে ছাড়ে। এয়ার ইন্ডিয়ার ৮টি-সহ অন্যান্য সংস্থার ১৬টি বিমান দেরিতে ছেড়েছে।
১৯২৭-এর ১৯ ডিসেম্বর দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী রামপ্রসাদ বিসমিল ও আশফাকুল্লা খানের ফাঁসি হয়েছিল। ধর্ম আলাদা হলেও দু’জনে অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন। হিন্দু-মুসলিমে ভেদাভেদ করা সিএএ-র প্রতিবাদ করার জন্য তাই এই দিনটিই বেছেছিলেন বামেরা। তাঁদের প্রধান কর্মসূচি ছিল, মান্ডি হাউস থেকে লালকেল্লা পর্যন্ত মিছিল। কিন্তু দিল্লি পুলিশ অনুমতি দেয়নি। মিছিলের জন্য জড়ো হতেই পুলিশ সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাট, বৃন্দা কারাট, ডি রাজা, হান্নান মোল্লা, নীলোৎপল বসুদের আটক করে বাসে করে তুলে নিয়ে যায়। পরিকল্পনা ছিল, দিল্লির সীমানাবর্তী বাবনার স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ইয়েচুরিরা কাশ্মীরি গেটে বাস থেকে নেমে পড়ে যন্তরমন্তরে ফেরেন। পুলিশ সূত্রের খবর, বিকেল পর্যন্ত অন্তত ১২০০ জন আটক হয়েছেন। ১৩ হাজার পুলিশ নামানো হয়েছে।
তাতে কী লাভ হয়েছে? ছাত্রছাত্রীরা যখন গলা ফাটিয়ে স্লোগান তুলছেন, তাঁদের জল-খাবার বিলি করেছেন ত্রিলোকপুরীর গাড়ি সারাইয়ের কর্মী মহম্মদ শাহিদ ও তাঁর বন্ধুরা। জেএনইউ, জামিয়া, অশোক, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আইনজীবীরা। অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের হাতে পোস্টার ছিল, কালো রেখায় আঁকা মোদীর মুখ ক্রমশ হিটলারের চেহারা নিচ্ছে। যন্তরমন্তরে ফুটপাথে তিন মহিলা হাতে দড়ি বেঁধে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন ‘সংবিধান বাঁচাও’ পোস্টার নিয়ে। এক জেএনইউ ছাত্রী হাজির হয়েছিলেন জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ বই হাতে। মুখে মুখে ঘুরেছে ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জের কবিতা, ‘বোল কি লব আজাদ হ্যায় তেরে’।
মোদী সরকার যে বলছে বিক্ষোভকারীরা দেশের জনসংখ্যার সামান্য অংশ? লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের জবাব, ‘‘স্বাধীনতা সংগ্রামেও তো দেশবাসীর একাংশই লড়েছিলেন।’’ তাঁর গলা ছাপিয়ে যন্তরমন্তর গান ধরেছে, ‘সরফরোশি কি তমান্না অব হমারে দিল মে হ্যায়।’