কেমন হয় যদি মাসের শুরুতে দেশের মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন নরেন্দ্র মোদী! ২০১৯-এ ফের ক্ষমতায় ফিরতে মোদী সরকার তেমনটাই পরিকল্পনা করছে।
মনমোহন-সনিয়ার ইউপিএ সরকার রোজগার ও খাদ্য সুরক্ষা দিতে আইন করেছিলেন। এ বার মাস গেলে ন্যূনতম আয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকার বন্দোবস্ত করতে চাইছে মোদী সরকার। যার মূল মন্ত্র হল, সরকারের তরফ থেকে নাগরিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম আয় বাবদ টাকা পৌঁছে দেওয়া। ১ ফেব্রুয়ারি অরুণ জেটলির বাজেট এ বিষয়ে দিশা দেখাতে পারে। মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন তাঁর আর্থিক সমীক্ষাতেও এর পক্ষে সওয়াল করবেন।
সরকারি সূত্রের খবর, হয়তো আগামী অর্থ বছর থেকেই এই প্রকল্প চালু হবে না। আপাতত ভাসিয়ে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারে সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের প্রকল্প।
ইউপিএ-সরকারের প্রথম জমানায় এনআরইজিএ বা একশো দিনের কাজের প্রকল্প চালু হয়েছিল। অনেকেরই মতে, ইউপিএ-র দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার পিছনে এই প্রকল্পের বড় ভূমিকা ছিল। সরকারের দ্বিতীয় দফায় পৌঁছে ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’-কে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ করতে চেয়েছিলেন সনিয়া-মনমোহন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। মোদী সরকারের কোনও মন্ত্রী অবশ্য এখনও সকলের জন্য ন্যূনতম আয় বা ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ নিয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু সুব্রহ্মণ্যন জানিয়েছেন, তিনি এর পক্ষে। জল্পনা উস্কে জম্মু-কাশ্মীরের অর্থমন্ত্রী হাসিব দ্রাবু ঘোষণা করেছেন, রাজ্যে দারিদ্রসীমার নীচের সবাইকে সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেবে। জম্মু-কাশ্মীরে জোট সরকারের শরিক বিজেপি। সে রাজ্যেই এই ঘোষণায় মোদী সরকারও একই পথে হাঁটতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
প্রশ্ন হল, মোদী সরকার কি সবাইকেই নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দেবে, নাকি শুধুমাত্র দারিদ্রসীমার নীচের হতদরিদ্র, বেকার, শারীরিক ভাবে রোজগারে অক্ষম মানুষের হাতে কিছুটা অর্থ তুলে দেবে, যাতে তাদের আয় অন্তত দারিদ্রসীমার সমান নয়? অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, সকলকে ন্যূনতম আয় পাইয়ে দেওয়াটা সাধ্যের বাইরে। খাদ্য, সার, রেলের ভাড়া, বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাস থেকে রেশনের চিনি, কেরোসিন, জলে ভর্তুকি দিতে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি মিলে প্রায় ৩.৪ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে। যা দেশের জাতীয় আয় বা জিডিপি-র প্রায় ৪.২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের কারও কারও অনুমান, সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের বন্দোবস্ত করতে গেলে জিডিপি-র প্রায় ১১ থেকে ১২ শতাংশ খরচ হবে। যা সরকারের সাধ্যের বাইরে।
নীতি আয়োগের উপাধ্যক্ষ অরবিন্দ পানাগাড়িয়া তাই যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘সকলের জন্য নয়। শুধু যাদের দরকার, তাদেরকেই প্রয়োজন মতো টাকা দেওয়া হোক। জন ধন যোজনায় দেশের সিংহভাগ মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ২০১১-র সামাজিক-অর্থনৈতিক জাতিগত জনগণনা হয়েছে। যা থেকে কারা গরিব ও কারা গরিব নয়, তা স্পষ্ট।’’ বর্তমানে দারিদ্রসীমার মাপকাঠি হল গ্রামে দৈনিক আয় ৩২ টাকা এবং শহরের ক্ষেত্রে দৈনিক আয় ৪৭ টাকা। কিন্তু সুব্রহ্মণ্যনের মতো অনেক অর্থনীতিবিদের যুক্তি, খরা, চাষের ক্ষতি, পরিবারে অসুখের চিকিৎসার খরচের ফলে অনেকেই যে কোনও সময় দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান। ফলে কার, কখন সরকারি মদত দরকার, তা চিহ্নিত করা কঠিন। সুরজিৎ ভাল্লার মতো অর্থনীতিবিদরা তাই সওয়াল করছেন, ওই ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে আয়ের দিক থেকে নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষকে প্রতি মাসে বা বছরে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাইয়ে দিক সরকার। তাতেই গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ উপকৃত হবেন।
ইউপিএ-সরকারের একশো দিনের কাজ বা খাদ্য সুরক্ষা আইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, এ হল পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। একই ভাবে, ন্যূনতম আয় সরকার পাইয়ে দিলে কাজের উৎসাহ কমবে বলে যুক্তি রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ হতে পারে। বাড়তে পারে খেতমজুরদের মজুরি, চাষের খরচ। পাল্টা যুক্তি হল, মধ্যপ্রদেশে দু’টি জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে পরীক্ষামূলক ভাবে এই প্রকল্প চলেছিল। কেউই রোজগারের চেষ্টা ছেড়ে দেননি। বাজে খরচ আটকাতে বাড়ির মহিলাদের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার পরামর্শও রয়েছে। খেতমজুরদের মজুরি বাড়লে তাতে গরিবদেরই লাভ।
ইউরোপের ফিনল্যান্ডের মতো দেশে সকলের জন্য ন্যূনতম আয় নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে। সুইৎজারল্যান্ডেও প্রস্তাব ছিল। কিন্তু মানুষ গণভোটে তা খারিজ করেছেন। পি চিদম্বরম প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘মাথা পিছু আয়ের হিসেবে সুইৎজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড বিশ্বের ধনীতম দেশগুলির অন্যতম। এ দেশে এই ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হল, ন্যূনতম আয় কতখানি হওয়া প্রয়োজন? তা দিতে গিয়ে কি অন্যান্য ভর্তুকি তুলে দেওয়া হবে? সবাইকে দেওয়া হবে নাকি জনসংখ্যার বাছাই করা অংশকে?’’ জেটলি তাঁর বাজেটে এই সব প্রশ্নের উত্তর দেন কি না, সে দিকেই এখন নজর।