রাস্তার ভিক্ষুক থেকে বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার। চেন্নাইয়ের সেই ছেলে জয়াভেলের কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। রাতারাতি তাঁর গল্প ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। প্রশংসা এবং আশীর্বাদের বন্যা বয়ে গিয়েছিল তাঁর উপর।
কিন্তু জানেন কি, তাঁর এই অসামান্য উদয়ের নেপথ্যে আসলে কাদের হাত ছিল? কাদের ছত্রছায়ায় এ রকম অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন জয়াভেল?
এ ভাবে জয়াভেলের জীবনকে আমূল বদলে দেওয়ার পিছনে ছিলেন দু’জন মানুষ— উমা এবং তাঁর স্বামী মুথুরাম।
জয়াভেলের জন্ম অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরে। বাবা-মা ছিলেন কৃষক। কিন্তু ঋণের বোঝায় ডুবে থাকা পরিবার একসময় সব ছেড়ে দিয়ে চেন্নাই পাড়ি দেয়। জয়াভেলরা পাঁচ ভাই-বোন। তাঁদের বাবা ভেবেছিলেন, চেন্নাই পৌঁছে যে কোনও একটা চাকরি করবেন।
কিন্তু অনেক খুঁজেও কোনও চাকরি জোটাতে পারেননি বাবা। এক সময় সপরিবারে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করতে শুরু করেন তাঁরা। এখানেই তাঁদের দুর্ভাগ্য থেমে থাকেনি। জয়াভেল তখন মাত্র তিন বছরের, তাঁর বাবা মারা যান। অবসাদে থাকা মা-ও মদের নেশায় বুঁদ হয়ে যান। বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে পারতেন না তিনি।
এমন এক কঠিন সময়ে ১৯৯৯ সালে উমা এবং মুথুরামের নজরে আসেন জয়াভেল। জয়াভেল এবং তাঁর ভাইবোনদের সিরাগু মন্টেসরি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন তাঁরা। উমা-মুথুরাম সুয়াম চ্যারিটেবল ট্রাস্ট চালাতেন। স্কুলটা এই ট্রাস্টেরই।
এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জয়াভেলকে। দ্বাদশ শ্রেণিতে ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করার পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন। সেখান থেকে অ্যাডভান্স অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি।
জয়াভেল একটা উদাহরণ মাত্র। উমা-মুথুরামের ছত্রছায়ার প্রতিনিয়ত বড় হয়ে উঠছে এমন কয়েকশো শিশু। যেমন ২৫ বছরের দশারথন রাজারামানি বর্তমানে একজন ডাক্তার। তাঁর ভাই ধনরাজ একজন ইঞ্জিনিয়ার। এঁরা দু’জনেই ইট কারখানায় শিশু শ্রমিকের কাজ করতেন এক সময়।
প্রথম শ্রেণিতে পড়াকালীন উমা এবং মুথুরামের পরিচয়। প্রাইমারিতে দু’জনেই খুব ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জানতেন না যে, তাঁরা জীবনসঙ্গী হতে চলেছেন।
১২ বছর বয়সে উমার পথ চলা শুরু। মা ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। মায়ের হাত ধরেই বস্তির বাচ্চাদের সঙ্গে পরিচয় তাঁর। বস্তির ছেলেদের পড়াতে শুরু করেন উমা। তাঁর সঙ্গে পরবর্তীকালে এই কাজে যোগ দেন মুথুরাম এবং আরও কয়েক জন বন্ধু।
সে সময় উমার মাত্র ১৬ বছর বয়স ছিল। রক্তদান শিবির, গরিবদের ছানি অপারেশন বা দুর্ঘটনাগ্রস্ত কোনও ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসা, এ সবই নিয়মিত করতে শুরু করেন তিনি।
সেই ছোট বয়স থেকেই ক্রমে গরিব শিশুদের সেবা করতে শুরু করেন তিনি। কখনও গুরুতর জখম শিশুশ্রমিককে বিনা পয়সায় চিকিত্সা করিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। কখনও ছুটে গিয়েছেন বিক্রি হয়ে যাওয়া শিশুকে উদ্ধার করতে।
এর পর ১৯৯৯ সালে উমা এবং মুথুরাম দু’জনে সুয়াম চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-এর রেজিস্ট্রেশন করান। ২০০৩ সালে এই ট্রাস্ট সিরাগু মন্টেসরি স্কুল শুরু কর বাচ্চাদের জন্য। খুব দ্রুত ছাত্র সংখ্যা ৩০ থেকে ৩০০০ গিয়ে দাঁড়ায়।
উমা-মুথুরামের ছত্রছায়াতেই ধনরাজ, জয়াভেলস-এর মতো অনেকেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এটা সবে শুরু, বলছেন উমা-মুথুরামরা।