বহু ইতিহাসের সাক্ষী ভারতের যমুনা নদী। সাত সন্তানের মধ্যে একমাত্র মেয়ের তাই সাধ করে নাম রেখেছিলেন ওই নদীর নামেই। বাবা-মা যদিও তখন জানতেন না তাঁদের এই মেয়েই একদিন নাম স্বার্থক করে ইতিহাস তৈরি করবেন। পরে যাঁকে বিশ্ব সুমতি মোরারজি নামে চিনবে।
পুরুষ শাসিত সমাজে তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি একটা জাহাজ কোম্পানির মালিক হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম মহিলা যিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল শিপ ওনারস্ অ্যাসোসিয়েশনের (ইনসা)-ও প্রধান হন। ১৯৭১ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হয়েছিলেন।
১৯০৯ সালে ১৩ মার্চ মুম্বইয়ে গোঁড়া রক্ষণশীল ব্যবসায়ী পরিবারে তাঁর জন্ম। ছোট থেকে কোনও কিছুরই অভাব ছিল না তাঁর। বাধা ছিল শুধু স্বাধীনতায়। পড়াশোনাও সে ভাবে শিখে উঠতে পারেননি তিনি। রক্ষণশীল বাবা মাত্র ১৩ বছর বয়সে এসসিইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির মালিকের ছেলে শান্তিকুমার নরোত্তম মোরারজির সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন।
আর্থিক দিক থেকে শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ছিল অনেকটাই ভাল। শ্বশুরের অবর্তমানে তাঁর স্বামীই যে এই কোম্পানির সর্বেসর্বা হবেন, সে নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না। তবে পারিবারিক ব্যবসায় যে ভাবে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন সুমতি মোরারজি, সেই ইতিহাস সত্যিই অভাবনীয়।
প্রথম থেকেই অবশ্য যমুনার উপস্থিত বুদ্ধি এবং শেখার ক্ষমতা শ্বশুর নরোত্তম মোরারজিকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। ইংরাজি, হিন্দি এবং মরাঠি তিনটি ভাষাতেই অনর্গল কথা বলতে পারতেন যমুনা। শ্বশুর নরোত্তম মোরারজি ঠিক করে তাঁর নাম বদলে দেবেন। শ্বশুরের ইচ্ছাতেই যমুনা থেকে সুমতি হয়ে উঠলেন তিনি। সংস্কৃতে সুমতি কথার অর্থ উচ্চতর জ্ঞান সম্পন্ন মহিলা।
ক্রমে পারিবারিক ব্যবসাতে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়তে থাকেন তিনি। এ দিকে শাশুড়ির মৃত্যুর পর গৃহস্থালীর সমস্ত কাজ দেখাশোনার ভারও তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। মাত্র ২০ বছর বয়সে তাঁর স্বামী তাঁকে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর করে দেন। ১৯২৩ সালে ওই শিপিং কোম্পানিতে তাঁর যোগদান।
১৯৫৬ সালে তিনি শিপিং কোম্পানির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ এবং তারপর ১৯৬৫ সালে ফের প্রেসিডেন্ট হন তিনি। একা হাতে ৬ হাজার কর্মচারীর দেখভাল করতেন তিনিই।
স্বাধীনতা সংগ্রামেও সুমতি মোরারজির ভূমিকা ছিল। মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন তিনি। এমনকি দেশভাগের সময় সিন্ধিদের পাকিস্তান থেকে ভারতে আসতে সাহায্যও করেছিলেন।
১৯৪৭-এর পর আন্তর্জাতিক ব্যবসায় আমদানি-রফতানিতে জাহাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুমতি মোরারজির অভিজ্ঞতা ভারতীয় ব্যবসায় ভীষণ ভাবে কাজে লেগেছিল তখন।
১৯৯৮ সালের ২৭ জুন সুমতিদেবীর মৃত্যু হয়। তাঁকে ‘মাদার অফ ইন্ডিয়ান শিপিং’ বলা হত। তাঁর লেখা বই আজও অনুপ্রেরণা জোগায়। সমাজসেবায় তিনি ছিলেন অগ্রণী।