স্কুলের গণ্ডি পেরতে পারলি না! তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। জীবনটাই ব্যর্থ। দশম শ্রেণির পরীক্ষায় যখন উত্তীর্ণ হতে পারেননি, তখন এ সব কথাই উড়ে এসেছিল তাঁর দিকে। না, অপমানের বদলা নিতে কোমর বেঁধে পড়াশোনা চালিয়ে দারুণ রেজাল্ট করেননি তিনি। বরং পরিস্থিতির চাপে স্কুলে যাওয়াই বন্ধ হয়ে যায়।
সেই স্কুল ড্রপআউট যে জীবনে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবেন তা কল্পনাতেও ভাবেননি দোদ্দাবল্লাপুরের বাসিন্দারা। স্কুল ড্রপআউট-ই এখন লড়ে চলেছেন কর্নাটককে বাঁচানোর জন্য! শুধু ডিগ্রি থাকলেই যে প্রকৃত বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হওয়া যায় না, তা ফের প্রমাণ করলেন তিনি।
চিদানন্দ মূর্তি। কর্নাটকের দোদ্দাবল্লাপুরের বাসিন্দা। জন্ম থেকেই যে তিনি খুব অভাব-অনটনের জীবন দেখেছেন তা নয়। বাবার পাওয়ার লুম ছিল। কিন্তু ব্যবসায় মন্দা আসে। চিদানন্দ তখন নবম শ্রেণিতে পড়তেন। চোখের সামনে বাবাকে ভেঙে পড়তে দেখেছিলেন।
সেই সময় তাঁদের সংসারে মাসিক আয় হাজার টাকায় নেমে এসেছিল। বাধ্য হয়ে তাঁর বাবা একদিন পাওয়ার লুম মেশিনটাকেই বেচে দেন। সামান্য মাইনেতে স্থানীয় একটি দোকানের হিসাবরক্ষক হিসাবে যোগ দেন। সেই সব টানাপড়েন থেকেই হয়তো পড়াশোনার প্রতি ইচ্ছাটা চলে যাচ্ছিল চিদানন্দের। তাই দশম শ্রেণিতে অনুত্তীর্ণ হওয়ার পর আর স্কুলে যাননি।
যতটা পারতেন বাবাকে সংসারে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। তবে ছোট থেকেই প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন চিদানন্দ। চোখের সামনে প্রকৃতির ক্রমে ধ্বংস হয়ে চলার রূপ কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। প্রকৃতি বাঁচাতে, সর্বোপরি নিজের রাজ্য কর্নাটককে বাঁচাতে বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
দোদ্দাবল্লাপুরের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে অর্কবতী নদী। খুব ছোট নদী অর্কবতী। এক সময় বেঙ্গালুরুর জলের প্রধান উৎস ছিল এটাই। কিন্তু বালি মাফিয়াদের উৎপাতে সে নদী প্রায় মজে গিয়েছে। জল শুকিয়ে এসেছে। এমনই অবস্থা যে, বর্ষাতেও জলে ভরে উঠছে না এই নদী। নদী বাঁচাতে বেআইনি ভাবে বালি তোলার কাজ বন্ধ করার দরকার ছিল।
অর্কবতী আবার কাবেরি নদীতে গিয়ে মিশেছে। অর্কবতীর জল শুকিয়ে গেলে কাবেরি নদীরও বড় মাপের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল। আর কাবেরি নদীর ক্ষতি হলে সমগ্র কর্নাটকবাসী বিপদে পড়বেন। রাজ্যের সম্ভাব্য বিপদের কথা যেন আগেই দেখতে পেয়েছিলেন চিদানন্দ। তাই অর্কবতী রক্ষা করতে নেমে পড়েন তিনি।
কিন্তু এই কাজ একা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাই তিনি প্রথমে কাজ করতে শুরু করেন অর্কবতী রেজুভেনেশন কমিটির সঙ্গে। পরে ২০১১ সালে কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তোলেন তিনি। নাম দেন ‘যুব সঞ্চালনা’।
বেআইনি ভাবে বালি তোলার ফলে শুধু জলজ প্রাণীর মৃত্যুই ঘটছিল না, জলও ক্রমশ শুকিয়ে আসছিল। কারণ এই বালিই নদীর জল ধরে রাখে।
দীর্ঘ দিন ধরেই নদী রক্ষার কাজ করে চলেছেন চিদানন্দ মূর্তি। কিন্তু ক্ষতি এতটাই যে, নদীকে এখনও পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেননি তিনি। এর সঙ্গে রয়েছে বালি মাফিয়াদের শাসানি। কিন্তু কোনও কিছুই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি।
চিদানন্দ জানাচ্ছেন, যদি আমরা আমাদের আশেপাশের নদীর যত্ন না করি, তা হলে এমন দিন আসতে দেরি নেই যখন আমরা খাওয়ার জন্য একফোঁটা জলও পাব না। প্রকৃতি রক্ষার পাশাপাশি এলাকাবাসীদের মধ্যে জল সংরক্ষণের সচেতনতার পাঠও দিচ্ছেন তিনি।
চিদানন্দের এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে প্রশংসনীয় কাজ কাদানুরু কাইমারা জঙ্গলে ৪০ হাজারেরও বেশি প্রজাতির দেশীয় গাছ লাগানো। অতিরিক্ত জল শোষন করায় স্থানীয় প্রশাসনকে জঙ্গলের ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল বন দফতর। তারপরই চিদানন্দের এই সিদ্ধান্ত।
প্রতি বছর তাঁর সংস্থার সদস্য মুখ বদলে যায়। ভাল চাকরি পেয়ে চিদানন্দকে ছেড়ে চলে যান তাঁর সহকর্মীরা। চিদানন্দও চাইলে কোনও না কোনও চাকরি জুটিয়ে নিতেই পারতেন হয়ত। কিন্তু মাস মাইনের লোভ ছেড়ে প্রকৃতিকেই বাঁচিয়ে চলেছেন তিনি। স্কুলের গণ্ডি না পেরনো চিদানন্দকে নিয়ে আজ তাই গর্বের শেষ নেই দোদ্দাবল্লাপুরের।