‘বসন্তী’র মথুরায় কংসবধ, স্বস্তিতে বাসিন্দারা

নগরীর মধ্যে গড়ে ওঠা ‘গব্বর’-এর ডেরা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে বারো ঘণ্টা হতে চলল। কিন্তু তার পরেও সেখানে ঢুকতে চেয়ে আজ ফিরেই যেতে হল ‘বসন্তী’কে!

Advertisement

অগ্নি রায়

মথুরা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০৩:৫৬
Share:

নিহত দুই পুলিশ অফিসার মুকুল দ্বিবেদী এবং সন্তোষ যাদবকে শ্রদ্ধা মথুরার সাংসদ হেমা মালিনীর। শনিবার। ছবি: পিটিআই।

নগরীর মধ্যে গড়ে ওঠা ‘গব্বর’-এর ডেরা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে বারো ঘণ্টা হতে চলল। কিন্তু তার পরেও সেখানে ঢুকতে চেয়ে আজ ফিরেই যেতে হল ‘বসন্তী’কে!

Advertisement

গত দু’বছর ধরে মথুরার ২৭০ একরের প্রকাণ্ড জওহর বাগকে কার্যত ‘রামগড়’ বানিয়ে ছেড়েছিলেন আজাদ ভারত বিচারক ক্রান্তি সত্যাগ্রহীর নেতা রামবৃক্ষ যাদব, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ২২ জনের মধ্যে যাঁর মৃতদেহ মিলেছে বলে জানিয়েছেন ডিজি জাভিদ আহমেদ। বহু দেরিতে টনক নড়া উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের গত দেড় দিনের পুলিশি অভিযানের পর আজ যখন উদ্যানে শেষ তল্লাশি চলছে, বেলা এগারোটায় সেখানে এসে পৌঁছন হেমা মালিনী— মথুরার সাংসদ। প্রায় মিনিট দশেক হেমার গাড়ি গেটে দাঁড়িয়ে থাকার পর পুলিশ কর্তারা সবিনয়ে জানান, ‘‘ম্যাডাম আপনি ফিরে যান। এখন তল্লাশির কাজ চলছে। কেউ ভিতরে গেলে কাজে ব্যাঘাত হবে!’’ কথা না-বাড়িয়ে পত্রপাঠ ফিরে গেল স্থানীয় সাংসদের মাখন সাদা হন্ডা।

তাঁকে নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক ধুয়ে ফেলতে ড্রিম গার্ল আজ পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন ‘‘আমার পক্ষে গোটা দিন এখানে বসে থাকাটা সম্ভব নয়। এখানে কী ঘটছে সেটাও আমার জানার কথা নয়। তার পরেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছি। রাজ্য সরকার এত দিন কী করছিল? কোথায় অখিলেশ যাদব?’’

Advertisement

বিজেপি শীর্য নেতৃত্বের কাছ থেকে ভর্ৎসনা শুনেই আজ যে তড়িঘড়ি এখানে ছুটে এসেছেন হেমা— এ কথা সত্য। এটাও স্বাভাবিক যে, ঘটনার পর আজ দিল্লি-আগরা হাইওয়ের কাছে মথুরা বাইপাসে মঞ্চ গড়ে অখিলেশ সরকারকে তীব্র আক্রমণ শুরু করেছেন প্রদেশ বিজেপির নেতারা। আগামী বছর উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের জন্য একটি হাতে-গরম বিষয় পেয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক লাভ তোলার চেষ্টা করছে মায়াবতীর দলও। কিন্তু এই ঘোলা জলে মাছ ধরার চিরাচরিত চিত্রনাট্যকে ছাপিয়ে আজ উঠে আসছে এক অত্যাশ্চর্য জবরদখলের গল্প! সেই গল্পের নায়ক রামবৃক্ষ যাদবের মৃতদেহ মেলার কথা আজ পুলিশ সরকারি ভাবে জানালেও, স্থানীয় মানুষ নিশ্চিত ছিলেন— তিনি বেঁচে নেই। দু’বছর আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকার পর আজ তাঁদের চোখমুখে দৃশ্যতই কংসবধের আনন্দ। ‘‘দু’বছর ধরে এই অত্যাচার সহ্য করেছি আমরা। কাছে গেলেই ওর বাহিনী ডান্ডা মারত, ইট-পাথর ছুড়ত। সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ’’, জানাচ্ছেন উমেশ ঠাকুর। জওহর বাগকে ঘিরে উত্তরপ্রদেশ সচিবালয়ের তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের কলোনিতে শ’খানেক পরিবারের বাস। উদ্যানের পাঁচিলের গায়ে এই কলোনিতেই কলেজ ছাত্র এই উমেশের বাড়ি। পাঁচিলের ও-পারে যতদূর চোখ যায় আম আর পেয়ারা গাছের ছোট ছোট বাগিচা। উমেশ বলেন, ‘‘আগে ওখানে আমরা মর্নিং ওয়াক করতাম। বাচ্চারা খেলাধুলো করত। সব বন্ধ করে দিয়েছিল ওরা।’’

কারা এই ‘ওরা’? ২০১৪-র মার্চে সত্যাগ্রহ করতে মধ্যপ্রদেশের সাগর এলাকা থেকে এসেছিল একটি সংগঠন। উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে এই বাগানে এক দিনের জন্য ধর্না বিক্ষোভের অনুমতি চেয়েছিল তারা। একটা দিন গড়িয়ে দু’বছর কাবার, গোটা উদ্যান আজ তাদের দখলে!

এই কলোনির আর এক বাসিন্দা কাপ্তান সিংহ বলেন, ‘‘ওদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। সকলের হাতে ডান্ডা, নীল পতাকা আর রাইফেল-বন্দুক। মহিলা, বাচ্চাদেরও অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আমরা ভয়ে কাছে ঘেঁষতাম না। শুধু দেখতাম, বড় বড় গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে। মান্ডি থেকে রেশন মজুত করে দিয়ে গাড়ি আবার চলে যেত। ভয়ে মানুষ মুখ খুলত না!’’

মথুরা সেনা ছাউনি এবং সদরবাজার থানা এলাকা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে এমন এক মুক্তাঞ্চল। দিনের পর দিন পেশি প্রদর্শন, হুমকি, নৈরাজ্য চলছে আর পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়, কী ভাবে এটা হতে পারে! কলোনির এক বাসিন্দা বাবলি দেবী উঠোনের কিনারে বাঁধা গরু সামলাতে সামলাতে বললেন, ‘‘ওরা তো লাউড স্পিকারেও হুমকি দিত। আমাদের এই কলোনি উচ্ছেদের ভয়ও দেখাতো।’’ বলে চলেন তিনি— স্পিকারের মুখ ঘোরানো থাকতে সেনা ছাউনির দিকে। আওয়াজ তুলত— জয় হিন্দ, জয় সুভাষ। সঙ্গে বিচিত্র দাবি। টাকায় ৬০ লিটার পেট্রোল দিতে হবে, ভারতীয় নোট বাতিল করে আজাদ হিন্দ বাহিনীর নোট ছাপতে হবে। রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে— এই সব।

সুভাষচন্দ্রের নাম যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে এই ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী। তার কারণটি বড়ই বিচিত্র। এই মথুরাতেই রয়েছে জয়গুরুদেবের আশ্রম, যিনি মারা যান ২০১২-তে। এই গুরুদেব ঘোষণা করেছিলেন, আগের জন্মে তিনি নেতাজি ছিলেন! সত্যাগ্রহী নাম নেওয়া এই দলটির নেতা রামবৃক্ষ যাদব এই জয়গুরুদেবের চ্যালা। সেই সূত্রে নেতাজিরও!

যে রহস্যময় গাড়িগুলি ভর্তি করে চাল ডাল চিনি আসত, স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ সেগুলির মালিক কনৌজের এক ভূমি মাফিয়া। একই সঙ্গে অভিযোগ— অখিলেশ সব জানতেন, কিন্তু ওদের কয়েক বার বোঝানোর চেষ্টা ছাড়া বিশেষ কিছু করেননি তাঁর কাকা শিবপাল যাদবের কারণে। শিবপালও ছিলেন ওই জয়গুরুদেবের ভক্ত। শেষ পর্যন্ত আদালত নির্দেশ দেওয়ায় জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে অখিলেশের পুলিশ। আর তাতেই এই হইহই কাণ্ড।

সদরবাজার থানার স্টেশন অফিসার প্রদীপ কুমার বলছেন, ‘‘আমাদের কাছে ওপর থেকে যখন নির্দেশ এসেছে তখনই আমরা অ্যাকশন শুরু করেছি। ভাল করে রেইকি-ও করতে পারিনি। তাই মার খেতে হয়েছে। এসপি সাহেব শহিদ হয়েছেন। হেলমেট না থাকলে আমিও বাঁচতাম না’’ কনুইয়ে গভীর ক্ষত। ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থাতেই তল্লাশি সেরে ফিরেছেন। জানালেন ‘রণক্ষেত্র’ থেকে মিলেছে ৫৬টি রাইফেল, কার্তুজ, গ্রেনেড। কাগজপত্র বা ইস্তেহার জাতীয় কিছু নেই, জবরদখলকারীরা পালানোর সময় গ্যাসের আগুনে সব পুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এই অভিযান চালাতে কেন দু’বছর লেগে গেল?

এই প্রশ্নের জবাবে রুক্ষ স্বরে জানালেন অফিসার, ‘‘আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।’’

তাঁর এই না-বলতে চাওয়ার মধ্যেই সম্ভবত লুকিয়ে রইল জবাবটা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement