চলছে উদ্ধার-কাজ। ছবি পিটিআই
মণিপুরের নোনে জেলায় মারাংচিং স্টেশনের কাছে বুধবার গভীর রাতে নামা ধসের জেরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ জনে। তার মধ্যে ২০ জনই টেরিটোরিয়াল আর্মির সদস্য। নিখোঁজের সংখ্যা ৩২। শনিবার ধসের তলা থেকে উদ্ধার হয়েছে আরও ৬টি মৃতদেহ। সেনাবাহিনী ধসে চাপা পড়া দেহের সন্ধানে থরো ওয়াল রেডার ব্যবহার করছে। এ দিন মারাংচিং এলাকায় পাহাড়ের অন্য অংশ ধসে পড়ে। তবে তাতে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
সেনাবাহিনী জানায়, উদ্ধার হওয়া এক জেসিও-সহ ১৪ জনের দেহ আজ বায়ুসেনার দুটি বিশেষ বিমান ও সেনার হেলিকপ্টারে তাঁদের বাড়়িতে পাঠানো হয়েছে। এঁদের মধ্যে এক জন সিকিম, এক জন পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, এক জন মণিপুরের কাংপোকপি ও বাকিরা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিঙের বাসিন্দা।
অন্য দিকে ধসে ত্রিপুরার দুই বাঙালি জওয়ান, সিপাহীজলা জেলার বিশালগড়ের কসবা এলাকার সঞ্জয় দেবনাথ এবং খোয়াই জেলার কল্যাণপুরের প্রশান্তকুমার দেবের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
প্রশান্তকুমার দেবের মৃতদেহ শনিবার উদ্ধার হয়েছে বলে পারিবারিক সুত্রে জানানো হয়েছে।
প্রশাসন সূত্রে শনিবার মোট নিখোঁজ, মৃত ও উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয় সেই তালিকা অনুযায়ী ১০৭ নম্বর টেরিটোরিয়াল আর্মির বি কোম্পানির মোট ৪৩ জন জওয়ান ও জেসিও, বেঙ্কট সাই কনস্ট্রাকশনের ২৩ জন কর্মী, রেলের ৩ ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মী, ভারত ইনফ্রা প্রাইভেট লিমিটেডের তিন জন, পাঁচ গ্রামবাসী ও শনাক্ত না হওয়া আরও চার জন মিলিয়ে মোট ৮১ জন ধসের সময় ওই এলাকায় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সেনার ২০ জন, বেঙ্কট সাইয়ের ৬ জন, ভারত ইনফ্রার ১ জন ও শনাক্ত না হওয়া দুই জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাই সরকারি ভাবে এখনও নিখোঁজের সংখ্যা ৩২। এনডিআরএফ ও এসডিআরএফের মোট ১০৯ জন, পুলিশ ও দমকলের ১৩৮ জন, ১০ আসাম রাইফেলসের ২০৫ জন ও ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবী মিলিয়ে শনিবার ৪৭৭ জন উদ্ধারকারী কাজ চালাচ্ছেন।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার নির্দেশে মন্ত্রী পীযূষ হাজরিকা উদ্ধারকাজ তদারক করতে নোনে গিয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে তিনি জানান, ‘‘অসমের বাসিন্দারা ২টি নির্মাণ সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। সাত জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। ১২ জন নিখোঁজ। গোলকগঞ্জের রেল ইঞ্জিনিয়ার কমলেশ তালুকদার নিখোঁজ। নিখোঁজদের দেহ অসমে পাঠানোর ব্যবস্থা করাই আমার প্রথম কাজ।’’
মণিপুরের ধসে কার্যত তছনছ হয়ে গিয়েছে অসমের মরিগাঁওয়ের লাহরিঘাটের বাসিন্দাদের জীবন। ধসে চাপা পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে লাহরিঘাটের ১৭ জন-সহ মরিগাঁও জেলার বাসিন্দাই ২৩ জন। এখন পর্যন্ত জেলার তিন জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। অত্যন্ত দরিদ্র এই অঞ্চলের কুশতলি ও আশপাশের এলাকার মানুষ মূলত দিনমজুরি করেই সংসার চালান।
মরিগাঁওয়ের রমেন ফুকন জানান, “তখন রাত দেড়টা বাজে। অন্য দিনের মতোই পাহাড়ের কোলে থাকা কর্মী শিবিরে সকলে একসঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎই সব কেঁপে উঠল। কি হচ্ছে বুঝে ওঠার আগে গোটা পাহাড়টা ভেঙে পড়ল। সুনামির মতো কাদা-পাথরের ঢেউ আমাদের ঘরগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে নামতে থাকল। কী হয়েছিল মনে নেই। সকালে জ্ঞান ফিরে কোনও মতে কাদা থেকে নিজেকে টেনে তুললাম। দেখি, কর্মী শিবির থেকে কাদার ঢল আমাদের প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে নিয়ে এসেছে।” লাহরিঘাটের মহেশ্বর ফুকন, মণিরাম ফুকনেরা ইম্ফলের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁরা জানান, কপালজোরে বেঁচেছেন। পাহাড় ভাঙা ঢল তাঁদের কর্মী শিবির থেকে এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে নিয়ে গিয়েছিল।
অসম তৃণমূলের সভাপতি রিপুন বরার নেতৃত্বে তৃণমূলের প্রতিনিধি দল আজ লাহরিঘাট গিয়ে মৃত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে। রিপুন বলেন, ‘‘হতদরিদ্র পরিবারগুলি একমাত্র রোজগেরে সদস্যদের হারিয়েছে। তাই সরকারের তরফে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের এক জনকে চাকরি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’’
অসমের বজালির ভবানীপুরে রৌমারি গ্রামের বাসিন্দা, ২৯ বছরের জিয়ারুল হকের মৃতদেহ উদ্ধারের খবর আসায় কান্নার রোল ওঠে পরিবারে। ২০১৩ সালে টেরিটোরিয়াল আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন জিয়ারুল। ২ বছর ও তিন মাসের দুই সন্তান রয়েছে তাঁর। মাস দেড়েক আগে, ছোট ছেলেকে দেখতে শেষ বার বাড়ি এসেছিলেন তিনি। বুধবার বেলা ২টো নাগাদ বাবার সঙ্গে কথা হয়েছিল তাঁর। রাতে শোওয়ার আগে ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন জিয়ারুল। বৃহস্পতিবার সেনার তরফে ফোন করে জানানো হয় ধসে চাপা পড়েছে টেরিটোরিয়াল সেনার শিবির। জিয়ারুল হকের শেষকৃত্য আজ সম্পন্ন হয়।