সাউথ অ্যাভিনিউয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে মমতা, প্রাক্তন বিজেপি নেতা সুধীন্দ্র কুলকার্নি (বাঁ দিকে) ও সুরকার জাভেদ আখতার ছবি— পিটিআই।
বিজেপি-বিরোধী ঐক্য মজবুত করা নয়। বরং রাজনৈতিক শিবিরের মতে, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের পরে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় দিল্লি সফরে স্পষ্ট যে, বিভিন্ন রাজ্যে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতেই বেশি আগ্রহী তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। উদ্দেশ্য, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে প্রধান বিরোধী শক্তির ভূমিকায় নিজেদের তুলে ধরা।
মঙ্গলবার তিন অ-বিজেপি নেতার হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দিলেন মমতা। প্রাক্তন কংগ্রেসি এবং রাহুল গাঁধীর ঘনিষ্ঠ হরিয়ানার নেতা অশোক তনওয়ার, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের টিকিটে লড়ে হেরে যাওয়া বিহারের কীর্তি আজাদ এবং বিহারেরই জেডি(ইউ) সাংসদ পবন বর্মা। এ দিন সাউথ অ্যাভিনিউয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসভবনে এসে মমতার সঙ্গে দেখা করে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিলেন তাঁরা।
সন্ধ্যায় তনওয়ারের যোগদানের পরে বাইরে এসে মমতা বলেন, “রাজ্যগুলি না এগোলে দেশ এগোবে না। আমি হরিয়ানা যেতে চাই। দিল্লির ঘরের কাছেই হরিয়ানা, পঞ্জাব। অশোক তনওয়ারজি যত তাড়াতাড়ি ডাকবেন, আমি পৌঁছে যাব। জয় হরিয়ানা, জয় বাংলা।”
বুধবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করবেন মমতা। তৃণমূল সূত্রে দাবি, তার আগে থাকবে একটি চমকও। কিন্তু আজ সারা দিন কোনও শীর্ষ পর্যায়ের বিরোধী নেতার সঙ্গে দেখা করেননি তৃণমূল নেত্রী। কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গাঁধীর সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। বরং একের পর এক প্রাক্তন কংগ্রেসিদের দলে নিয়ে তিনি কার্যত ১০ জনপথের দিকে চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিয়েছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির। ঘটনা হল, আজ যাঁরা তৃণমূলে যোগ গিলেন, তাঁরা কেউই সেই অর্থে রাজনৈতিক ‘হেভিওয়েট’ নেতা নন। কিন্তু দিল্লি এসে বিজেপি-বিরোধী সমন্বয় না করে কংগ্রেসের শিবির থেকে এই যোগদানে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে কংগ্রেসে। রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, এর পরে অদূর ভবিষ্যতে তৃণমূলের হাত ধরে মোদী-বিরোধিতা করার রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সনিয়া এর পরে নিজেও আর কতটা তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে মৈত্রী রচনায় উদ্যোগী হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পারস্পরিক ‘অ্যালার্জি’ (বিশেষত রাহুল গাঁধীর ক্ষেত্রে) বাড়লে, বেশ কিছু লোকসভা আসনে বিজেপি সরাসরি লাভবান হতে পারে।
দিল্লির রাজনৈতিক মহল জানাচ্ছে, আজ তৃণমূলে যোগ দেওয়া তনওয়ার এক সময়ে ছিলেন রাহুলের খুবই ঘনিষ্ঠ নেতা। এই প্রাক্তন যুব কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ঠিক দু’বছর আগে দল ছাড়েন ভূপিন্দর সিংহ হুড়ার সঙ্গে লড়াইয়ের জেরে। ‘আপনা ভারত মোর্চা’ নামে একটি সংগঠন গড়েন তিনি। আজ তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে তনওয়ারকে প্রশ্ন করা হয়, পুরো প্রক্রিয়ায় কি বিরোধীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হচ্ছে না? তনওয়ার স্পষ্টই বুঝিয়ে দেন, কংগ্রেসের দ্বারা হবে না, বিজেপিকে হারাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই চাই।
তনওয়ারের কথায়, “মমতার নেতৃত্বেই দিশা দেখা যাচ্ছে। সবাই মিলে লড়াই করতে হবে। কৃষকরা যেমন একজোট হয়ে মোর্চা তৈরি করে লড়াই করেছেন, তেমনই সমস্ত বিরোধী দল মমতার নেতৃত্বে একজোট হলে বিজেপিকে হারানো সম্ভব। আসন্ন পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনেও তাদের অহংয়ের পতন দেখা যাবে।”
বিহারের দারভাঙা জেলা থেকে জেতা তিন বারের বিজেপি সাংসদ তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদের সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সমস্যা তৈরি হয়েছিল। আজাদ, জেটলির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। দলবিরোধী কার্যকলাপের জন্য তাঁকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে তাঁকে কংগ্রেস টিকিট দেয়। কিন্তু তিনি হেরে যান। আজ তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে প্রাক্তন এই ক্রিকেটার বলেন, “দেশের হয়ে অনেক খেলেছি। সাংসদ হয়েছি মানুষের ভোটে জিতে। এখন দেশে যে ভাবে বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে, তার মোকাবিলা করতে লড়াই করতে হবে। মমতাদিদির মধ্যে সেই নেতৃত্ব দানের শক্তি রয়েছে, যিনি মাঠে নেমে নিজে লড়াই করেন। তাঁর সঙ্গে এ বার আমিও যোগ দিলাম।”
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে দু’বছর আগে কীর্তির কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার দিনে উপস্থিত ছিলেন রাহুল। কীর্তির মাথায় ছিল মৈথিলি পাগড়ি। আজও যখন তৃণমূলে যোগ দিয়ে সপরিবার মমতার পা ছুঁতে দেখা গেল কীর্তিকে, মাথায় সেই একই মৈথিলি পাগড়ি!
তৃণমূলে যোগ দেওয়া পবন বর্মা বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মোদী সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন, তা দেখে বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে ওঁনার পাশে থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছি।’’ তাঁকেও প্রশ্ন করা হয়, বিরোধী ঐক্য কি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে না? পবনের জবাব, “সব প্রশ্নের উত্তর কি আজই পাওয়া যাবে? কিছু জিনিস ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়া ভাল।”
মমতা নিজে আজ সন্ধ্যায় জানান, তনওয়ার গোয়া এবং কলকাতায় যাবেন তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করতে। তার পরে হরিয়ানায় ঘুরে ঘুরে প্রচারের কাজ করবেন। আজ মমতার সঙ্গে দেখা করেন গীতিকার জাভেদ আখতার এবং প্রাক্তন বিজেপি নেতা সুধীন্দ্র কুলকার্নিও।