দু’জনেই জীবনের একটা বড় সময় যুদ্ধ, ধ্বংস ও হিংসার পরিবেশে দিন কাটিয়েছেন। দু’জনের দেশও আলাদা। তবু মনের রসদ আর সঙ্গীতের প্রতি তাঁদের অনুরাগই কয়েক হাজার মাইল দূরে বাস করা দুই জীবনকে গানের সুতোয় মিলিয়ে দেয়। দেশীয় রাজনৈতিক পটভূমির বাইরে বেরিয়ে সঙ্গীতের প্রতি আবেগই তাঁদের একসঙ্গে মনে রাখার পথকে প্রশস্থ করে।
এক জন জার্মানির সঙ্গীতজগতের অন্যতম মুখ, গীতিকার রিচার্ড স্ট্রস। অপর জন ভারতীয় এক মহারাজা, মহীশূরের জয়চামরাজেন্দ্র ওয়াদিয়ার। শুধু রাজত্ব সামলানোই নয়, যুদ্ধ, রাজনীতি, কূটনীতি সামাল দেওয়ার পরেও সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি জয়চামরাজেন্দ্রর এই অনুরাগই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।
রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে রাবণের বীণা বাজানোয় পারদর্শিতার কথা। মহাভারতেও নৃত্যপটীয়সী ছিলেন স্বয়ং অর্জুন। পুরাণের কাল থেকেই যুদ্ধে পারদর্শী রাজা-মহারাজাদের এমন গীতবাদ্যে আগ্রহের কথা শোনা যায়। মহীশূরের এই রাজাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
স্ট্রস মনে করতেন, মানুষের গলার স্বরই সবচেয়ে সেরা বাদ্যযন্ত্র, কারণ, তাকে ঠিক খাতে বাজানোই সবচেয়ে কঠিন। সুন্দর জীবন, সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা এবং উঁচুতারে সহজেই উঠতে পারা গলার স্বরকে পছন্দ করতেন তিনি। তারসপ্তকে খেলা করতে পারা গলার প্রতি দুর্বলতা ছিল মহীশূরের মহারাজ জয়চামরাজেন্দ্ররও। তাঁর নিজের গলার স্বরও ছিল সেই রকমই।
গান ও কবিতাকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার কাজটা কিশোর বয়স থেকেই শুরু করেছিলেন স্ট্রস। জীবনের সায়াহ্নে এসে তিনি তৈরি করলেন জীবনের সেরা চারটি গান। সেই গান গাওয়ানোর জন্য পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের জন্য উপযোগী ‘সোপ্রানো’ (গভীর ও উচ্চ মাত্রায় উঠতে পারে) স্বরের সন্ধানে ছিলেন তিনি।
সেই মাস্টারপিসগুলি গাওয়ানোর জন্য তাই গায়িকা ত্রিস্টেন ফ্ল্যাগস্ট্যাডকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখেন তিনি। লন্ডনে ক্রিস্টেনের অনুষ্ঠানেই এই গানগুলির প্রিমিয়ার পারফর্ম্যান্স হোক, এই ছিল তাঁর ইচ্ছা। ক্রিস্টেনকে লেখা সেই চিঠি আজও ত্রিস্টেন ফ্ল্যাগস্টাডের সংগ্রহশালায় রাখা রয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই চিঠি লেখার কয়েক দিন পরেই মারা যান স্ট্রস। তাই এ নিয়ে আর কথা এগোয়নি। আর এই এক চিঠি থেকেই স্ট্রসের সঙ্গে নাম জুড়ে যায় ভারতীয় মহারাজ জয়চামরাজেন্দ্রর।
স্ট্রসের এই চিঠির কথা জানতে পেরে সেই চিঠি পড়ার আগ্রহ জন্মায় তাঁর। সংগ্রহশালা থেকে চিঠিটি পড়ার পর অবিকল স্ট্রসের ইচ্ছা মতোই এক প্রিমিয়ার পারফর্ম্যান্সের আয়োজন করেন। গায়িকা অবশ্যই স্ট্রসের বেছে দেওয়া ত্রিস্টেন ফ্ল্যাগস্ট্যাড।
জয়চামরাজেন্দ্র মনস্থ করেন, প্রিমিয়ারের যাবতীয় ভাবনা একেবারে স্ট্রসের মনমতো হবে। স্ট্রসকে মরণোত্তর সম্মান প্রদানের সেই ইচ্ছে থেকেই ১৯৫০-এর ২২ মে, লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে এই প্রিমিয়ারের আয়োজন করেন তিনি।
গোটা প্রিমিয়ারে গান গাওয়ার জন্য ত্রিস্টেন ফ্ল্যাগস্টাডকে তৎকালীন সময়ে পাঁচ হাজার ডলার পারিশ্রমিক দেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, এই গোটা অনুষ্ঠানটির লাইভ রেকর্ডিংয়ের জন্যও ব্যয় করেন আরও অর্থ।
এই রেকর্ডকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রাখেন। জয়চামরাজেন্দ্রর ২০ হাজারের রেকর্ড সংগ্রহের মধ্যে এই রেকর্ডটি অন্যতম সেরা বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।
ইউরোপীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর এই আবেগ ও অবদান জয়চামরাজেন্দ্রকে সঙ্গীতমহলেও জনপ্রিয় করে তুলেছিল। রাজকীয় জীবনযাপনের পরও সময় বার করে সঙ্গীতচর্চায় ডুবে থাকতেন তিনি। তৎকালীন সময়ে অত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অর্কেস্ট্রা-সহযোগে এমন লাইভ পারফর্ম্যান্স দেখে ইউরোপীয় সঙ্গীতজ্ঞরাও একবাক্যে তাঁর সঙ্গীতের বোধকে কুর্নিশ জানান।