জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া।
হোলির দিনেই রং বদলালেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া! খাদের কিনারে ঠেলে দিলেন মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের সরকারকে।
আজ সকালে কানে এয়ারপডস গুঁজে নিজেই ল্যান্ড রোভার চালিয়ে, জ্যোতিরাদিত্য যখন দিল্লির বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, তখন জল্পনা তুঙ্গে— কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন? সনিয়া গাঁধী না অমিত শাহ? তিনি কি কংগ্রেস ছাড়ছেন? কংগ্রেস নেতৃত্ব কি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন?
সব প্রশ্নের একটাই জবাব দিলেন জ্যোতিরাদিত্য, ‘হ্যাপি হোলি।’
কিছু ক্ষণের মধ্যেই জল্পনার অবসান। প্রয়াত পিতা মাধবরাও সিন্ধিয়ার ৭৫তম জন্মবার্ষিকীর দিনে অমিত শাহের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকলেন জ্যোতিরাদিত্য। পৌনে এক ঘণ্টা পরে বেরিয়ে খানিক পরেই প্রকাশ করে দিলেন ‘ডিয়ার মিসেস গাঁধীজি’-কে পাঠানো তাঁর পদত্যাগপত্র। বস্তুত, সোমবারেই কংগ্রেস ছাড়ার সেই চিঠি লিখে ফেলেছিলেন তিনি। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই কংগ্রেসে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কে সি বেণুগোপাল বিবৃতি দিয়ে জানান, দলবিরোধী কাজের জন্য জ্যোতিরাদিত্যকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হল।
জ্যোতিরাদিত্যের বিজেপিতে যোগদান নিছক সময়ের অপেক্ষা। দিল্লিতে না গ্বালিয়রের রাজপ্রাসাদে ঢাকঢোল পিটিয়ে তিনি বিজেপিতে যোগ দেবেন, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। রাজ্যসভার প্রার্থী চূড়ান্ত করতে সন্ধ্যায় বিজেপির সদর দফতরে মোদী, শাহের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির বৈঠক বসে। সিন্ধিয়াকে মধ্যপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভায় জিতিয়ে এনে কেন্দ্রে মন্ত্রী করা হবে বলে বিজেপি সূত্রের খবর।
সিন্ধিয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেঙ্গালুরুর রিসর্টে আস্তানা গাড়া ১৯ জন কংগ্রেস বিধায়ক বিধানসভার স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তাঁদের মধ্যে ছ’জন রাজ্যের মন্ত্রী। পরে ভোপালে আরও তিন বিধায়ক পদত্যাগ করেন।
১৫ মাস আগে কমল নাথ মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার পর থেকেই প্রদেশ কংগ্রেসে বিবাদ শুরু। জ্যোতিরাদিত্য নিজের জন্য প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ ও তাঁর প্রতিনিধিকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী করার দাবি তুললেও কমল নাথ এক ইঞ্চি জমি ছাড়েননি। লোকসভা ভোটের পরে রাহুল গাঁধী কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোয় কমল নাথ-দিগ্বিজয় সিংহের মতো প্রবীণদের হাতেই ফের কংগ্রেসের রাশ চলে যায়। সিন্ধিয়া, সচিন পাইলটের মতো নবীন নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। সনিয়াকে আজ জ্যোতিরাদিত্য লিখেছেন, ‘‘১৮ বছর কংগ্রেসে থাকার পরে এখন দল ছাড়ার সময়। আপনি জানেন, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে এই পথ নিজেই তৈরি হয়েছে।’’
কিন্তু রাজস্থানের অশোক গহলৌত থেকে মধ্যপ্রদেশের অরুণ যাদব, প্রবীণ-নবীন দুই প্রজন্মের নেতারাই আজ ‘ক্ষমতার লোভে’ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার জন্য জ্যোতিরাদিত্যকে নিশানা করেছেন। গহলৌত বলেন, “এই ধরনের লোকেরা ক্ষমতা ছাড়া থাকতে পারেন না। তাই মতাদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। এঁরা যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেন, ততই মঙ্গল।”
নম্বরের খেলা
মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা
• মোট আসন: ২৩০
• (দু’জন বিধায়ক মারা যাওয়ায় ২২৮)
সোমবার পর্যন্ত
• কমল নাথ সরকারের পক্ষে (১২০)
• কংগ্রেস: ১১৩, বিএসপি: ২, এসপি: ১, নির্দল: ৪
• বিজেপি: ১০৮
মঙ্গলে পালাবদল
• (কংগ্রেসের ২২ জনের ইস্তফা গৃহীত হলে) মোট বিধায়ক: ২০৬
সিন্ধিয়া-বিরোধীরা মনে করাচ্ছেন, ২০০২ সালে কংগ্রেসে আসার দু’বছর পরেই সাংসদ হন জ্যোতিরাদিত্য। সাংসদ ছিলেন ২০১৯ পর্যন্ত। তার মধ্যে ২০১৪ পর্যন্ত কেন্দ্রে মন্ত্রী ছিলেন তিনি। কংগ্রেসের এই শ্রেণির নেতাদের মতে, জ্যোতিরাদিত্য কংগ্রেসের থেকে যা পেয়েছেন, তার তুলনায় দেননি প্রায় কিছুই। গত লোকসভা ভোটে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেখানে কিছু করে দেখানো তো দূরস্থান, মধ্যপ্রদেশে নিজের আসনই ধরে রাখতে পারেননি তিনি।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে হিংসার সময়ে টুইট করে বিজেপি নেতাদের ঘৃণা ছড়ানোর রাজনীতি বন্ধ করার ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন জ্যোতিরাদিত্য। হিংসার জন্য সমান দায়ী করেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারকেও। তার দু’সপ্তাহের মধ্যেই কী করে তিনি বিজেপির ঘরে ঢুকে পড়লেন, সেই বিস্ময়ও কাটছে না।
সিন্ধিয়ার দলত্যাগকে বড় ক্ষতি বলে মানলেও লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরীর মতে, এর পিছনে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অরুণ যাদবের অভিযোগ, “মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস কর্মীরা ১৫ বছর ধরে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে যে লড়াই করেছেন, উনি নিজের স্বার্থের জন্য তাকে জলাঞ্জলি দিলেন’’।
মধ্যপ্রদেশে ১৫ বছর পরে ক্ষমতায় ফেরা কংগ্রেস সরকারের পতন ঠেকাতে কমল নাথ শেষ চেষ্টা শুরু করেছেন। গত কালই তিনি সব মন্ত্রীর পদত্যাগপত্র নিয়ে নিয়েছিলেন। বিধায়ক হিসেবে ইস্তফা পাঠানো ছয় মন্ত্রীকে সরানোর কথা জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্যপালকে। আজ ভোপালে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের বৈঠকে ‘ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণের জন্য’ জ্যোতিরাদিত্যের নিন্দা করে প্রস্তাব পাশ হয়েছে। তার পরে কমল নাথ বলেছেন, ‘‘চিন্তার কোনও কারণ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করব। আমাদের সরকার পুরো পাঁচ বছরই টিকবে।’’
যদিও অধীরের মন্তব্য, “আমার মনে হয় না, রাজ্যে কংগ্রেস সরকারের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে।” রাজ্যের কংগ্রেস নেতা লক্ষ্মণ সিংহও মানছেন, “আমাদের বিরোধী আসনে বসার জন্য তৈরি হতে হবে।” একটি সূত্রের মতে, কংগ্রেসের সবাই মিলে পদত্যাগ করে ফের ভোটে যাওয়ার কথাও ভাবছেন কমল নাথেরা।
উল্টো দিকে ভোপালে বিজেপি দফতরে একইসঙ্গে হোলি ও অকাল দীপাবলি উদযাপন শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতায় ফেরার গন্ধ পেয়ে শিবরাজ সিংহ চৌহানকে পরিষদীয় দলনেতার পদে ফেরানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
কমল নাথ নিজেই গদি না-ছাড়লে আগামী সপ্তাহে শুরু হতে চলা বাজেট অধিবেশনে অনাস্থা প্রস্তাব আনবে বিজেপি। কমল নাথের হার নিশ্চিত করতে এসপি, বিএসপির বিধায়কদের সঙ্গেও শিবরাজ দেখা করেন। কংগ্রেস যাতে দল ভাঙাতে না-পারে সে জন্য আজ দলের সব বিধায়ককে রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে বিজেপি।