নেই বিরোধীরা। মঙ্গলবারের লোকসভা। পিটিআই
শ্রমবিধির মতো বিতর্কিত ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিলও বিরোধীশূন্য লোকসভায় পাশ করিয়ে নিল মোদী সরকার।
রাজ্যসভায় গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের অভিযোগে এবং বিতর্কিত জোড়া কৃষি বিল ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে মঙ্গলবার লোকসভা ত্যাগ করেন বিরোধীরা। সেই বিরোধীশূন্য কক্ষেই তিন শ্রমবিধি নিয়ে আলোচনা চলল তিন ঘণ্টার বেশি। যার বেশির ভাগ সময় জুড়েই প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারের উদ্যোগে এমন ‘ঐতিহাসিক’ বিল আনার প্রশস্তি করলেন সরকার পক্ষের সাংসদেরা। কিন্তু বিধি এতটাই বিতর্কিত যে, সমর্থন জুগিয়েও অবাধ কর্মী ছাঁটাইয়ের রাস্তা প্রশস্ত হওয়া, স্থায়ী চাকরি কমে ঠিকা কাজের রমরমা বৃদ্ধি, শ্রমিকদের স্বার্থে আঘাতের বিষয়ে প্রশ্ন তুলল একাধিক শরিক দল। তার পরেও বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ‘ফেলে না-রেখে’ এ দিনই তড়িঘড়ি পাশ হল তিন বিধি।
সংস্কারের লক্ষ্যে ৪৪টি কেন্দ্রীয় শ্রম আইনের মধ্যে ১৫টিকে বর্তমান সময়ের জন্য অপ্রাসঙ্গিক বলে বাতিল করেছে কেন্দ্র। বাকি ২৯টিকে নিয়ে আসছে চারটি শ্রমবিধিতে। এর মধ্যে লোকসভা ও রাজ্যসভায় মজুরিবিধি পাশ হয়েছে গত বছরই। এ দিন লোকসভায় আলোচনা ছিল বাকি তিনটির (শিল্পে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক বিধি, সামাজিক সুরক্ষা বিধি এবং কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চয়তা বিধি) বিষয়ে।
আরও পড়ুন: দাম বাড়লেই হস্তক্ষেপ নয়
বিরোধীদের অভিযোগ, নতুন শিক্ষানীতি তৈরি ও প্রয়োগের জন্য করোনা-কালেও তর সয় না এই সরকারের। কৃষি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কারের পথে হাঁটার জন্যও এই সময়কে বেছেছে তারা।
প্রশ্ন উঠছে, এত কিসের তাড়া? যে আইনের সঙ্গে ৫০ কোটি শ্রমিকের ভাগ্য জড়িয়ে, তার রূপরেখা চূড়ান্ত করার আগে কেন বিরোধীদের আপত্তির জায়গাগুলি শোনার ধৈর্য দেখাবে না সরকার? যেখানে কৃষি বিল নিয়ে এমন টানাপড়েন চলছে, সেখানে এক-দু’দিন বাড়তি অপেক্ষায় আপত্তি কোথায়? বিল পাশের পরেই একাধিক শ্রমিক সংগঠনগুলি কেন্দ্রীয় ভাবে এক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছে, বুধবার থেকেই শ্রম বিধি-সহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিবাদে পথে নামছে তারা।
আরও পড়ুন: অনড় সরকার পক্ষ, বয়কটে বিরোধীরা, সংসদের পরে আন্দোলন রাজ্যে
সংখ্যার জোরে বিল পাশ হয়তো আটকাত না। কিন্তু লোকসভায় বিরোধীরা থাকলে যে এই তিন বিধির বিষয়ে কড়া প্রশ্নের মুখে পড়তে হত সরকারকে, তা স্পষ্ট হল শরিকদের আপত্তিতেই। বিজেডি, ওয়াইএসআরসিপি-র মতো শরিকের সাংসদেরাও প্রশ্ন তুললেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। লোকসভায় গত বছর শুধু মজুরি বিধি নিয়েই আলোচনা হয়েছিল ৪ ঘণ্টার বেশি। সেখানে তিনটি বিধি নিয়ে এ দিন আলোচনা হয়েছে ৩ ঘণ্টার সামান্য বেশি।
এখন ১০০ জন পর্যন্ত কর্মীর সংস্থায় ছাঁটাই করতে কিংবা সেখানে ব্যবসা বন্ধের তালা ঝোলাতে সরকারি অনুমতি লাগে না। বিলে প্রস্তাব, সেই সংখ্যা ৩০০ করার। যেখানে নতুন প্রযুক্তির কারণে এমনিতেই নিয়োগ কম, চাকরি বাড়ন্ত, সেখানে কোন যুক্তিতে সরকার এমন অবাধ ছাঁটাইয়ের রাস্তা মসৃণ করছে, সেই প্রশ্ন উঠল। শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গঙ্গোয়ারের যুক্তি, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের মতো ১৬টি রাজ্য ইতিমধ্যেই ওই কর্মী সংখ্যা তিন গুণ করেছে। তা ছাড়া, এই রাস্তা খুলে দিলে আরও অনেক বেশি সংস্থা এখানে লগ্নি করার সূত্রে আখেরে কাজের সুযোগ বাড়বে। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নগুলির প্রশ্ন, বিদেশি সংস্থার বিনিয়োগ টানাই শুধু পাখির চোখ? তাতে শ্রমিক-স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও আপত্তি নেই কেন্দ্রের? বিরোধীরা থাকলে, এই প্রশ্ন সংসদেও জোর গলায় উঠত।
মন্ত্রীর দাবি, কর্মী-স্বার্থ মাথায় রেখে ঠিকা নিয়োগেও স্থায়ী চাকরির সমান সুবিধার কথা লেখা রয়েছে নতুন বিধিতে। কিন্তু তাতে শরিকরাও বলেছেন, ঠিকা নিয়োগের সর্বোচ্চ সময়সীমা বেঁধে না-দিলে, উল্টে কমে যাবে পাকা চাকরি। স্থায়ী নিয়োগের দিকে ঝুঁকতে চাইবে না কোনও সংস্থাই।
গঙ্গোয়ারের দাবি, বিধিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের তথ্যভাণ্ডার তৈরির উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। পিএফ, ইএসআইয়ের মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে অ্যাপ-বরাতে কাজ করা ‘গিগ কর্মী’, এমনকি পরিযায়ী শ্রমিকদেরও। বিভিন্ন সরকারি সুবিধার আওতায় আনতে বদলানো হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংজ্ঞা। প্রস্তাবিত নিয়মে, অন্য রাজ্যে গিয়ে মাসে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতনে কাজ করা যে কেউই পরিযায়ী কর্মী। তার জন্য ঠিকাদার মারফত নিযুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কর্মী কমানোর পথ প্রশস্ত করেও বেকার ভাতা কিংবা বিমার কথা প্রস্তাবিত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে কোথায়? ঠিকাদারদের বাড়তি সুবিধা দিতে গিয়ে দুর্ভোগ বাড়বে না তো পরিযায়ী শ্রমিকদের? মন্ত্রীকে শুনতে হয়েছে, বহু বিলেই আইনি ফাঁক অজস্র। পরবর্তী সময়ে সংসদ ও ত্রিপাক্ষিক বৈঠক এড়িয়ে নিয়ম বদলের রাস্তা খোলা। যা সমস্যার কারণ হতে পারে।