গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
অফিসের ব্যস্ত সময়ে হামিদিয়া রোড দিয়ে যেন গাড়ি এগোতেই চায় না। ঠিক যেন কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। যানজটে থমকাতে থমকাতে অবশেষে হামিদিয়া রোডকে পিছনে ফেলে ঘিঞ্জি গলিতে প্রবেশ। কয়েকটা বাঁক ঘুরতেই ভোপালের ‘অযোধ্যা’র সামনে এসে থামল গাড়ির চাকা।
বিতর্কিত জমির এক পাশে রামমন্দির, অন্য প্রান্তে মসজিদ। এই দুই ধর্মীয় স্থানের মধ্যে ওই জমিতে রামমন্দির তৈরিকে কেন্দ্র করে দশকের পর দশক ধরে চলছে রাজনীতি। এ বারও লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এবং কংগ্রেসের ভোটপ্রচারে জায়গা করে নিয়েছে সেই ‘রামমন্দির’।
দিগ্বিজয় সিংহকে প্রার্থী করে ভোটযুদ্ধে প্রথমেই বিজেপিকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে কংগ্রেস। পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ দিগ্বিজয়ও ভালই জানেন, ‘কট্টর হিন্দুত্বের মুখ’ বলে পরিচিত সাধ্বী প্রজ্ঞাকে কুপোকাত করতে হলে, কী ভাবে পালে হাওয়া টানতে হয়। তাই এ বার রাহুলের ‘ন্যায় যোজনা’র থেকেও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে হিন্দুত্ব ইস্যু।
ভোপালের সেই বিতর্কিত জমি।
সাধ্বী প্রজ্ঞার নাম ঘোষণার আগেই, রাম নবমীর দিন দিগ্বিজয় ওই বিতর্কিত জমিতে নতুন করে রামমন্দির তৈরির কথা ঘোষণা করে চমক দিয়েছিলেন।
বিতর্কিত জমির নথিপত্র।
এটা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু মনে করেন না প্রজ্ঞাঘনিষ্ঠ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা দীলিপ খান্ডেলওয়াল। তাঁর কথায়: “রামবন্দির ট্রাস্টের নামে রয়েছে ওই জমি। সেই নবাব আমল থেকেই খাতায় কলমে হিন্দুদের জমি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বার বার ওই জমি দখলের চেষ্টা হয়েছে। সম্প্রতি ইসমাইল কাবাড়ি নামে এক ব্যক্তি এক ভুয়ো কাগজ দেখিয়ে জমির মালিকানা দাবি করেছেন। এ নিয়ে মামলাও চলেছে। দিগ্বিজয় সিংহ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বিতর্কিত জমির একাংশ আবার কংগ্রেস পার্টির নামে রেজিস্ট্রি হয়ে যায়। ভোট বড় বালাই। তাই এখন রামমন্দিরের কথা শোনা যাচ্ছে দিগ্বিজয়ের মুখে।”
আরও পড়ুন: বাংলায় মমতাদিকেই দরকার, বিজেপির চালে ছিন্দওয়াড়া দখল নিয়ে বলছেন কমলপুত্র
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, দিগ্বিজয় এক ঢিলে দুই লক্ষ্যে আঘাত হেনেছেন। এক দিকে তিনি যেমন রাম মন্দির কমিটি এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাদের খুশি করে বিজেপির হিন্দুত্বের ভোটে ভাগ বসাতে চেয়েছেন। তেমনই ‘দিগ্বিজয় সিংহ হিন্দুবিরোধী’ দুর্নামও ঘোচাতে চাইছেন। ভোটপ্রচারে নেমে সাধ্বী প্রজ্ঞাও এতটুকু জায়গা ছাড়তে নারাজ। ‘গেরুয়া সন্ত্রাস’ শব্দবন্ধের প্রবক্তা মনে করিয়ে দিয়ে দিগ্বিজয়কে হিন্দু বিরোধী বলছেন সাধ্বী।
রাম মন্দিরে কংগ্রেস প্রার্থী দিগ্বিজয় সিংহ।
২০০৮ সালে ইউপিএ জমানায় মালেগাঁও বিস্ফোরণে প্রজ্ঞা গ্রেফতারের পর, এই ঘটনাকে ‘গেরুয়া সন্ত্রাস’ বলে প্রচার করে কংগ্রেস। বিজেপি মনে করে, পিছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন দিগ্বিজয়ই। এ বার ভোট ময়দানের লড়াইয়ে সেই প্রজ্ঞাই এখন দিগ্বিজয়ের সামনে। ভোপাল কেন্দ্রে দিগ্বিজয়ের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীর নাম ঘোষণা হতেই কপালে ভাঁজ পড়েছিল বিজেপির। কে লড়বেন? প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছিলেন না অমিত শাহরা।
নরেন্দ্র সিংহ তোমর, উমা ভারতী, শিবরাজ সিংহ চৌহানের মতো নেতারাও দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত সাধ্বী প্রজ্ঞাকেই বেছে নিতে হয় বিজেপিকে। হাজার বিতর্ক হলেও তাঁর পক্ষেই সওয়াল করতে শোনা গিয়েছে খোদ নরেন্দ্র মোদীকে।
আরও পড়ুন: তেজ বাহাদুরের আবেদন কমিশনকে খতিয়ে দেখতে বলল সুপ্রিম কোর্ট
গোটা দেশের মধ্যে ভোপাল এখন সবার নজরে। কয়েক মাস আগেই বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেসের মনোবল অনেকটাই চাঙ্গা। কিন্তু তা বলে বিজেপি পিছিয়ে রয়েছে, এই যুক্তি মানতে নারাজ ভোপালের বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁদের দাবি, সাধ্বী প্রজ্ঞা নিজস্ব রণকৌশলেই এগোচ্ছেন। প্রজ্ঞা যেমন বড় বড় প্রচার, রোড শো করছেন, তেমনই ভোটারদের দোরগোরাতেও পৌঁছে যাচ্ছেন।
এই কেন্দ্রে এমনিতেই বিজেপির ভোট বাক্স মজবুত। ভোপালে প্রায় ৬৯ শতাংশ হিন্দু ভোটার এবং প্রায় ২৬ শতাংশ মুসলমান। ভোপালের সিংহাসনে বসতে হলে, এই অঙ্কও মাথায় রাখতে হচ্ছে বহু প্রার্থীকে। ১৯৮৯ সাল থেকে ভোপাল কেন্দ্র বিজেপির দখলে। ২০১৪ সালে বিজেপির ঝুলিতে ৬৩.১৯ শতাংশ ভোট আসে। বিগত লোকসভা নির্বাচনগুলিতে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের আশেপাশেই রয়েছে পদ্মের ভোট শতাংশের হিসেব। এ বারও দুর্গ অটুট থাকবে বলে আশা বিজেপির। এই মিথ শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে কি না অথবা দিগ্বিজয় সেই মিথ ভাঙতে পারবেন কি না— এই বিতর্কের অবসান ঘটবে ২৩ মে।
ছবি: প্রতিবেদক