পুলওয়ামার জঙ্গি আদিলের মা (বাঁ দিকে)। তাঁর পাশে আদিলের কাকিমা, যাঁর এক ছেলে বাড়ি ছেড়েছে জঙ্গি হয়ে। আর এক ছেলে জেলে বন্দি। নিজস্ব চিত্র
পুলওয়ামা হামলার পরে পেরিয়ে গিয়েছে দু’মাসেরও বেশি। এখনও ছেলে আদিলের অপেক্ষায় বাড়ির দাওয়ায় বসে দিন গোনেন মা হামিদা বানু।
আদিল আহমেদ দার, ওরফে ‘আদিল আহমেদ গাড্ডি টকরানেওয়ালা’। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সাড়ে তিনশো কেজি বিস্ফোরক-বোঝাই স্করপিয়ো নিয়ে যে ঢুকে পড়েছিল সিআরপি কনভয়ে। যে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান ৪৪ জন জওয়ান। তবু মায়ের মন এখনও মানতে চায় না, আদিল নেই। মানতে চায় না, এত ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা আদৌ সে ঘটাতে পারে। পুলিশ বলেছিল, আত্মঘাতী জঙ্গির দেহের চিহ্নমাত্র মেলেনি বিস্ফোরণের পরে। মায়ের ভরসা ওই খবরটুকুই— কে জানে, যদি ফিরে আসে কোনও দিন!
ওই একটা ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। বদলে গিয়েছে ২০১৯ সালের রাজনীতির ভাষ্য। সম্ভবত ভোটের ভাগ্যও। প্রত্যাঘাতে হয়েছে বালাকোট অভিযান। তার পাল্টা পাকিস্তানের হামলা। দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রকে যুদ্ধের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল পুলওয়ামা জেলার কাকাপোরার গনধিবাগ গ্রামের দোতলা বাড়ির মধ্যম পুত্র। আদিল আহমেদ দার ওরফে ‘আদিল আহমেদ গাড্ডি টাকরানেওয়ালা’।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
রাস্তায় দাঁড়ানো সন্দিগ্ধ চোখের মেপে নেওয়া চাহনি, বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ পেরিয়ে গনধিবাগ গ্রামের শেষ বাড়িটাতে পা দিতেই ভিড় করে এলেন স্থানীয়রা। বাড়ির লাগোয়া চাষের জমিতে জল দিচ্ছিলেন মা হামিদা। বাবা গুলাম আহমেদ তখন ব্যবসার কাপড় আনতে শ্রীনগরে। দোভাষীর মাধ্যমে জানা গেল, হামিদার তিন ছেলের মধ্যে আদিল ছিল মেজ। বড় ছেলে জাভেদ ‘মজদুরি’র কাজে বাইরে। পুলওয়ামা কাণ্ডের পরে ছোট ছেলে আরিফকে শ্রীনগরে মাসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে পরিবার। বাড়িতে পড়ে শুধু বুড়ো-বুড়ি।
গত মে মাসে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা চলাকালীন হঠাৎ উধাও হয়ে যায় আদিল। পরে জানা যায়, সে ভিড়ে গিয়েছিল জইশ-ই-মহম্মদের জঙ্গি দলে। এর কারণ ঠিক কী, তা এখনও খুঁজে চলেছে আদিলের পরিবার। আদিলের পাড়ার এবং স্কুলের বন্ধু ইলিয়াসের বক্তব্য, দু’বার ‘পুলিশি অত্যাচারের’ শিকার হয়েছিল আদিল। ২০১৬ সালে কাশ্মীরে দীর্ঘ সময় ধরে চলা কার্ফুতে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে রবার-বুলেট পায়ে লাগে তার। প্রায় এক মাস শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয় তাকে। দ্বিতীয় ঘটনায় আদিলকে প্রকাশ্য রাস্তায় মাটিতে নাকখত দিইয়েছিল পুলিশ। ইলিয়াসের ধারণা, সেই অপমানেই বন্দুক হাতে তোলে বছর আঠারোর সদ্য-তরুণ।
উপত্যকার যুবকদের জঙ্গি হওয়ার কারণ খুঁজতে ২০১৫ সালে একটি সমীক্ষা করেছিল কাশ্মীর প্রশাসন। দেখা যায়, কারণটা কখনও নিকটাত্মীয়দের উপরে পুলিশের অত্যাচার। কখনও বন্ধু, নিজের ভাই বা তুতো ভাইদের মধ্যে কারও জঙ্গি হয়ে যাওয়া। একই চৌহদ্দিতে থাকা আদিলের খুড়তুতো ভাই তৌসিফ বছর তিনেক আগে যোগ দিয়েছিল লস্কর ই তইবায়। জঙ্গি-সংস্রবের অভিযোগে তৌসিফের ভাইও এখন জেলে। এবং এই একটি বাড়ি কোনও ব্যতিক্রম নয়। গোটা গ্রামে প্রতি দু’টো বাড়ির মধ্যে একটায় জঙ্গি হওয়ার ইতিহাস রয়েছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রাই। যে কারণে দিনের বেলাতেও পুলিশ ঢুকতে ভয় পায় এই গ্রামে। অপারেশন চলে সব রাতে।
পরিবারের মধ্যে জঙ্গি হওয়ার ঘটনা ঘটলেও আদিল যে কোনও দিন ওই পথে হাঁটবে, স্বপ্নেও ভাবেননি হামিদা। মা বলেন, ‘‘বাড়িতে আমি ছাড়া আর কোনও মহিলা না-থাকায় গৃহস্থালির সমস্ত কাজ করত আদিল।’’ পড়ার পাশাপাশি মজুরি করে সংসারের ও মায়ের শখ মেটাত সে। সেই ছেলেই এতগুলো লোকের মৃত্যুর কারণ? বিশ্বাস হয় না হামিদার।
পুলিশের মতে, জইশে যোগ দিয়ে আত্মঘাতী জঙ্গি হওয়ার প্রশিক্ষণ পেয়েছিল আদিল। বিশেষ করে, কী ভাবে গাড়িবোমা নিয়ে সেনার উপরে হামলা চালানো যায়, তারই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল তাকে। ছেলের মৃত্যুর পরে কাশ্মীর সমস্যা মেটাতে আলোচনার উপরে জোর দিয়েছিলেন আদিলের বাবা। কিন্তু এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, এক দিকে পুলিশ-সেনার জুলুম বন্ধ করা ও অন্য দিকে স্থানীয় যুবকদের স্থায়ী রোজগারের ব্যবস্থা করে মূল স্রোতে ফেরাতে না-পারলে জঙ্গি সমস্যা মেটা মুশকিল।
কিন্তু আলোচনায় বসবে কে? এই প্রশ্ন ঘুরছে গোটা উপত্যকাতেই। দিল্লি তো অনেক দূর, ঘরের নেতা ওমর আবদুল্লা-মেহবুবা মুফতিরা উপত্যকার মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন একটু একটু করে। বিশেষ করে (বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়ার পরে) মেহবুবা। ওই পুরনো সিদ্ধান্তের জেরে এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে তাঁর দল পিডিপি। উপত্যকার তিনটি আসনের মধ্যে আদিলের বাড়ি যে লোকসভা কেন্দ্রে, সেই অনন্তনাগের জেতা আসন মেহবুবার পক্ষে ধরে রাখা মুশকিল বলেই মত স্থানীয়দের। উপত্যকার বাতাসে গুজব, হারের ভয়ে তলে-তলে হাত মিলিয়েছেন মুফতি ও আবদুল্লারা। ঠিক হয়েছে, অনন্তনাগে মেহবুবাকে জেতাতে যেমন দুর্বল প্রার্থী দিয়েছে ওমরের দল ন্যাশনাল কনফারেন্স, তেমনই ওমরের বাবা ফারুককে শ্রীনগর থেকে জেতাতে সর্বাত্মক সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন মেহবুবা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বারামুলা কেন্দ্রে দুই পরিবারের কোনও সদস্য প্রার্থী হননি। ফলে ওই কেন্দ্রই বলে দেবে, উপত্যকার সমর্থন কার দিকে রয়েছে। তবে পাল্লা ভারী ওমরের দলের। পিডিপি যেখানে নতুন মুখ আব্দুল কায়ুম ওয়ানিকে দাঁড় করিয়েছে, সেখানে ওমর বাজি রেখেছেন বর্ষীয়ান প্রার্থী তথা প্রাক্তন মন্ত্রী আকবর লোনের উপরে।
রাজনীতির কচকচি বোঝেন না হামিদা। হিসেবে কোথায় ভুল হল, তা-ই মেলাতে ব্যস্ত তিনি। বেরিয়ে আসার আগে মায়ের কাতর গলায় বাজতে থাকে শব্দগুলো— ‘‘আমি যেমন ছেলের শোকে কাতর, তেমনই আমার ছেলের কারণে যাঁরা সন্তান হারিয়েছেন, তাঁদের সকলকে আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাবেন।’’
চোখের জলে ভিজে যায় ভূস্বর্গের রক্তাক্ত মাটি। সন্তানহারা মায়েদের কান্না বিচ্ছিন্ন ভূস্বর্গকে মিলিয়ে দেয় দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে।