general-election-2019-national

ভাগ হয়ে যাচ্ছে বিরোধী ভোট, বিষণ্ণ মির্জা গালিবের গলি

আসাদউল্লা খান বেগ তথা মির্জা গালিবের এহেন গুণপনার কথা শুনে একটু চমক লাগল বই কি! এত বছর পরেও তিনি এই ধূলিধূসরিত গলির এক হতদরিদ্র ফলওয়ালার ভোট পেয়ে চলেছেন!

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৯ ০১:৩৫
Share:

ঘিঞ্জি: জীবন যেমন। —নিজস্ব চিত্র।

‘‘চল্লিশ বছর হয়ে গেল আমি তো গালিবের সঙ্গেই! কী করে ছাড়ব? ওঁর জন্যই তো হপ্তান্তে ক’টা ফল বেশি বিক্রি হয়। এই মন্দার বাজারে উনি পেটটা চালিয়ে দিচ্ছেন।’’

Advertisement

আসাদউল্লা খান বেগ তথা মির্জা গালিবের এহেন গুণপনার কথা শুনে একটু চমক লাগল বই কি! এত বছর পরেও তিনি এই ধূলিধূসরিত গলির এক হতদরিদ্র ফলওয়ালার ভোট পেয়ে চলেছেন!

কাসিমজান গলি ধরে বল্লিমারানে এসে পৌঁছেছি। এই বল্লিমরান সম্পর্কেই গুলজার লিখেছিলেন, ‘বল্লিমারান কে মহল্লে কি ওহ পেচিদা দলিলোঁ কি সি গলিয়াঁ...।’ অর্থাৎ বল্লিমরান মহল্লার গলিঘুঁজির নকশা জটিল দলিল-দস্তাবেজের মতোই প্যাঁচালো। চাঁদনি চক, বল্লিমারান, চাওড়ি বাজার হয়ে জামা মসদিজ পর্যন্ত হেঁটেও এগোনো মুশকিল, এতটাই ঘিঞ্জি। তারই মধ্যে গনগনে রোদের মধ্যে নিভু আলোয় শান্ত হয়ে রয়েছে গালিবের হাভেলি। ঠিক উল্টো দিকেই চল্লিশ বছরের ‘সঙ্গী’ ফলের ঠেলা নিয়ে দাঁড়ানো বৃদ্ধ, মুখতার। ‘‘শনি-রবিবার গালিবের হাভেলি দেখতে ভিড় হয়। অনেকে বিদেশ থেকেও আসে। বিক্রিবাটাও বাড়ে।’’ বোঝা গেল তাঁর সঙ্গে গালিবের সখ্যের রহস্য।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

চশমা, কাঁচের চুড়ি, চপ্পল আর বিয়ের কার্ডের দোকানে ঠাসা এলাকাটা। তেলেভাজা, রুহ আফজা, কাবাব, ভাল্লা পাঁপড়ি—সব মিলিয়ে এক প্রাচীন গন্ধ। ‘‘শুধু গত একমাস নয়, আগে থেকেই এখানকার আপ বিধায়ক ইমরান হুসেন আমাদের সঙ্গে আছেন। মাঝে মাঝেই এসে দোকানে ঢুকে পড়েন কোনও সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়াই,’’ জানাচ্ছেন শাফিকুল রহমান। একে রমজানের মাস, তায় প্রবল গরমের দুপুর। চোখে আগুন জ্বলছে বাব্বর অপটিকস হোলসেলার-এর মালিকের। নোটবন্দিতে যা চোট পেয়েছিলেন, তার ক্ষত এখনও শুকোয়নি। বলছেন, ‘‘আমরা যে হেতু গোটা দেশে পাইকারি ব্যবসা করি, জিএসটি-তে আমাদের তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ঘরে ঔরতদের যা পুঁজি জমানো ছিল, সব খালি। দাদি, খালা, নানিদের বদ দুয়া এ বার মোদীর সঙ্গে।’’ কিন্তু একই সঙ্গে শাফিকুল এ কথাও মনে করছেন যে, গোটা চাঁদনি চকের মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রায় ৬০ শতাংশ মোদী-বিরোধিতায় এককাট্টা হলেও এই আসনে বিজেপি প্রার্থী তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হর্ষ বর্ধনকে হারানো যাবে না।

চাঁদনি চকের এই ব্যবসায়ীর বক্তব্য যেন গোটা দিল্লির ভোটের ছবিকেই তুলে ধরছে। ২০১৪ সালের লোকসভায় বিজেপি পেয়েছিল ৪৬ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পেয়েছিল ১৫, আপ পেয়েছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ। সেই হিসেবে এ বার আপ-কংগ্রেস জোট হলে তারা বিজেপির থেকে বেশি পেত। ২০১৫ সালে দিল্লির বিধানসভা ভোটে বিজেপি ৭০টার মধ্যে মাত্র তিনটি আসন জিতলেও ভোট কিন্তু প্রায় ৩২ শতাংশ ধরে রেখেছিল। কংগ্রেসের ভোট ১০ শতাংশে নেমে আসে। তার ফায়দা তুলেছিল আপ।

পাশেই দাঁড়ানো আর এক সানগ্লাস ব্যবসায়ী সালমান আতিকের কথায়, ‘‘ঘুরে দেখুন। খোলাখুলিই লোকে কথা বলবেন। বিজেপিকে এক সুরে সবাই সমালোচনা করবেন। কেউ বলবেন, কংগ্রেসের জয়প্রকাশ অগ্রবালকে ভোট দেবেন। অনেকে আবার আপ-কে দিতে উৎসুক। বিরোধী ভোট যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারবেন।’’

বিজেপি প্রার্থী অথবা কর্মী প্রচারকেরা, ভোট-বাজারে এই মহল্লা মাড়াননি। এখানে একটি ভোটও যে পদ্ম চিহ্নে পড়বে না, সেটা জেনেই সম্ভবত বৃথা পরিশ্রম করতে চান না তাঁরা। ‘‘সে ভাবে কখনও সাম্প্রদায়িক অশান্তি না হওয়া এই এলাকায় বরং হিন্দুদের মধ্যে পাকিস্তানের নাম করে উস্কানি দিতেই ব্যস্ত বিজেপি,’’ জানাচ্ছেন দিলশাদ। এক চিলতে একটি দোকান চালান। ফিরোজাবাদ থেকে আনা বাহারি কাঁচের চুড়ি দিয়ে সাজানো। ‘‘আগে দিনে হাজার দশেক টাকার ব্যবসা হত। গত দু’বছরে এতটাই মন্দা যে, লাভ ছেড়ে দিন, সংসার চালানোর অবস্থাও প্রায় থাকছে না।’’

দিল্লি সরকারের ‘চাঁদনি চক রিডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং’-এর কাজ চলছে গত কয়েক বছর ধরে। কিন্তু উন্নয়ন কতটা এগিয়েছে স্পষ্ট নয়। জায়গায় জায়গায় রাস্তাঘাট প্রায় নরক হয়ে রয়েছে। স্থানীয় দোকানদাররা বলছেন, পুরনো হয়ে যাওয়া নালা-নর্দমা ফেটে জল উপচে পড়ে মাঝে মাঝেই পূতিগন্ধময় হয়ে যায় গোটা এলাকা। ‘‘কারও কোনও হেলদোল নেই। এমনিতেই ডিজিটাল যুগে বিয়ের কার্ড ব্যাপারটাই উঠে যাচ্ছে। তার মধ্যে দোকানের সামনে এই দুর্গন্ধ!’’ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ বিরক্ত ‘নবরতন ওয়েডিং কার্ড’-এর মালিক আর কে জৈন। পাশাপাশি অন্তত গোটা বারো কার্ডের দোকান একই ভাবে মাছি মারছে। ‘‘নোটবন্দি যখন হয়েছিল, তখন ভরা বিয়ের মরসুম। লোকের হাতে সে সময় বিয়ে করার টাকাই নেই তো কার্ডের অর্ডার কী দেবে! সেই যে শুরু হল হোয়াটসঅ্যাপে নেমন্তন্ন, ব্যস সেটাই চলছে।’’

সিপাহী বিদ্রোহের পর নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া গালিব দিল্লির ভাঙন দেখতে দেখতে এক দিনলিপি লিখেছিলেন। দিল্লির পতনে বিষণ্ণ কবি বলেছিলেন, ‘‘কেল্লা, চাঁদনি চক, গিরিন্দা বাজার, জুম্মা মসজিদ, প্রত্যেক সপ্তাহে যমুনার পুলে যাওয়া-প্রতি বছর ফুলওয়ালাদের মেলা। এই পাঁচ-পাঁচটি জিনিসই যখন নেই, তখন বলো দিল্লি শহরটা কোথায়?’

নাকে রুমাল চেপে চাউড়িবাজার থেকে বের হওয়ার সময় দেড়শো বছরের পুরনো লাইনগুলোই যেন জীবন্ত হয়ে উঠল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement