প্রচারে মেনকা গাঁধী। —নিজস্ব চিত্র।
ডেটলাইনটা কিন্তু সুলতানপুর থাকার কথা ছিল না।
যোগী আদিত্যরাজের আমলে মুঘলসরাই হয়ে গিয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর। ইলাহাবাদ হয়ে গিয়েছে প্রয়াগরাজ। আর ফৈজাবাদের নাম বদলে হয়েছে অযোধ্যা। সুলতানপুরের নামও কুশভাবনগর হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
কথিত, রামায়ণের রামচন্দ্রের ছেলে কুশের হাতে এই শহরের পত্তন। আলাউদ্দিন খিলজির সেনার ঘোড়ার খুরে মাটিতে মিশে যাওয়ার পর গোমতী নদীর ধারে নতুন সুলতানপুরের উত্থান। লোকসভা ভোটের আগে খোদ উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল রাম নায়েক সুপারিশ করেছিলেন, সুলতানপুরের নাম বদলে কুশভাবনগর রাখা হোক। ভোটের মরসুমে মুখ্যমন্ত্রী যোগী হয়তো আর সময় পাননি। না হলে সুলতানপুর নামক জেলা-শহর আর উত্তরপ্রদেশের মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যেত না।
যেমন খোঁজ মিলছে না ফিরোজ বরুণ গাঁধীর। সুলতানপুরের সাংসদ চলে গিয়েছেন অন্য কেন্দ্রে, পিলিভিটে। বরুণের মা মেনকা গাঁধী পিলিভিট থেকে আসন বদলে সুলতানপুরে চলে এসেছেন। সুলতানপুর বাজারের ঘণ্টাঘরের সামনে প্রতিদিনের জমায়েত জানে, বরুণের সুলতানপুরে জেতা কঠিন ছিল। তাই মা ছেলেকে নিজের সহজ আসন ছেড়ে দিয়ে নিজের কাঁধে জোয়াল তুলে নিয়েছেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গাঁধী পরিবারের পুত্রবধূ হয়েও বিজেপিতে নাম লেখানো, সাংসদ হওয়া, প্রথমে বাজপেয়ী সরকার, তার পর এখন মোদী সরকারের মন্ত্রী হওয়া যদি মেনকা গাঁধীর জীবনে রাজনীতির উলটপুরাণ হয়, তা হলে ৬২ বছর বয়সে ছেলের আসনে কঠিন লড়াই লড়তে এসে তাঁর জন্য আরও একটি নাটক অপেক্ষা করেছিল। তা হল, ভোটের ময়দানে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রয়াত স্বামীর বন্ধুর মুখোমুখি হওয়া।
১৯৮০-র লোকসভা ভোটে সুলতানপুরের পাশের কেন্দ্র অমেঠী থেকে সঞ্জয় গাঁধীর জয়ের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন আর এক সঞ্জয়— অমেঠীর রাজা সঞ্জয় সিংহ। মেনকাকে বিজেপি সুলতানপুরে প্রার্থী করায় কংগ্রেস সেই সঞ্জয়কেই এ বার সুলতানপুর থেকে প্রার্থী করেছে। তাঁর হয়ে প্রচারে এসেছেন মেনকার ভাসুরপো-ভাসুরঝি, রাহুল গাঁধী, প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা।
মেনকা প্রচারে টেনে নেমে আনছেন সঞ্জয়ের স্মৃতি। বছর খানেক প্রেম-পর্বের পর ১৯৭৪-এ মেনকার সঙ্গে যখন সঞ্জয়ের বিয়ে হয়, তখন মেনকা সবে ১৮-র চৌকাঠ পেরিয়েছেন। বাষট্টিতে পা দেওয়া মেনকা এ বার সুলতানপুরের গ্রামেগঞ্জে প্রচারে গিয়ে বলছেন, ‘‘আমি মেনকা সঞ্জয় গাঁধী। সুলতানপুরে প্রথম এসেছিলাম উনিশ বছর বয়সে, নয়ি-নভেলি দুলহন হিসেবে, স্বামীর সঙ্গে।’’ মেনকা এখানেই থামেন না। বলেন, ‘‘আমার স্বামী সুলতানপুরে চিনি কল এনে দিয়েছিলেন, হাসপাতাল, গোমতীর উপরে সেতু তৈরি করিয়েছিলেন। উনি যখন মারা যান, তখন আমার কোলে তিন মাসের ছেলে। সেই ছেলেও বাবার মতো সুলতাপুরকে ভালবাসে। এখানে কাজ করেছে।’’
সুলতানপুর বাজারের ৩৮ বছরের পুরনো লেপ-তোশকের দোকানের মালিক মহম্মদ রবিউল্লার কপালে প্রশ্নের ভাঁজ। ‘‘ছেলে ভাল কাজ করলে বিজেপি ওঁকে অন্য আসনে প্রার্থী করল কেন? চিনি কল তো প্রায়ই বন্ধ থাকে। আখ চাষিদের খুব সমস্যা। বরুণ গাঁধী বলেছিলেন, সব সমস্যা মিটে যাবে। হল কই?’’
বিজেপির চিন্তার কারণ হল, বিজেপির ঠাকুর, উচ্চবর্ণের ভোট কাটবেন সঞ্জয়। আবার এসপি-বিএসপি জোটের প্রার্থী, চন্দ্রভদ্র সিংহর ঝুলিতে যাদব, দলিত, তফসিলি জাতি, অনগ্রসর শ্রেণির বড় অংশের ভোট যাবে। সুলতানপুরের ‘রবিনহুড’ বলে পরিচিত চন্দ্রভদ্র। মায়ের হয়ে প্রচারে এসে বরুণ তাঁকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘‘আমি সঞ্জয় গাঁধীর ছেলে, এই ধরনের লোকেরা আমার পায়ের জুতো খুলে দেয়।’’ চন্দ্রভদ্ররই সুবিধা হয়েছে তাতে।
বাকি থাকে মুসলমান ভোট। অঙ্ক বলছে, সুলতানপুরের ভোটে জয়ের চাবিকাঠি এবার মুসলিমদেরই হাতে। মুসলিম ভোট পাবেন না ধরে নিয়েই বোধহয় সুলতানপুরে পা দিয়ে মেনকা কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ভোটের পর মুসলিমদের তাঁকে দরকার পড়বে। ‘আমরা মহাত্মা গাঁধীর সন্তান নই যে কিছু না পেলেও দিতেই থাকব’— এ হেন মন্তব্যের জন্য মেনকাকে নির্বাচন কমিশনের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। যেখানে যেমন ভোট মিলবে, সেখানে তেমনই কাজ হবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন মেনকা।
ভোটের প্রচারে প্রয়াত বন্ধুর স্ত্রী-কে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি সঞ্জয় সিংহ। কিন্তু গরমের সঙ্গে রাজনীতির উত্তাপও বেড়েছে। সঞ্জয় পুরনো ক্ষতেই নুন ছিটিয়ে বলছেন, ‘‘গোটা বিশ্ব যে ইন্দিরা গাঁধীকে আয়রন লেডি বলে মেনে নিল, তাঁর সঙ্গে মেনকার বনিবনা হয়নি। যে নিজের পরিবারের আপন হতে পারেনি, সে সুলতানপুরের কী আপন হবে!’’