Lok Sabha Election 2019

আপনি ফিনিশড্? সামান্য নীরবতা, তার পর ভেসে এল কণ্ঠ, রেকর্ডারটা অন করে নিন...

পাটিদারদের সংরক্ষণ আন্দোলন দিয়েই তরুণ এই তুর্কির আগমন হয়েছিল গুজরাত রাজনীতিতে। ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন বিজেপি-র। আরও স্পষ্ট করে বললে, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের।

Advertisement

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

আমদাবাদ শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ১৮:০৫
Share:

ভোটের সভায় হার্দিক: কংগ্রেসে জায়গা পেয়েও কি চোখে চিন্তার ছাপ!

হার্দিক পটেল ফিনিশড্‌? প্রশ্নটা যাঁকে করা হল অন্ধকারে তাঁকে প্রায় দেখা যাচ্ছে না। ফলে মুখটাও পড়া গেল না।

Advertisement

সাদা টয়োটা ফরচুনার ছুটছে আমদাবাদ শহরের ভিতরে। কখনও ৬০ তো কখনও ৮০। সামনের আসনে বসে হার্দিক স্বয়ং। মাঝের আসনে ভিন্‌রাজ্যের সাংবাদিক-সহ আরও দু’জন। আর একেবারে পিছনের আসনে এক জন ল্যাপটপ এবং ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। চালক-সহ প্রত্যেকের বয়সই ২৫-২৬ হবে। সেকেন্ড দশেকের মধ্যে জবাব এল, ‘‘বিলকুল নেহি। বরং মানুষের আরও কাছে পৌঁছেছি বলতে পারেন।’’

কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে সৌরাষ্ট্র— কোথাও তো তার নাম তেমন ভাবে শোনা যাচ্ছে না! সকলেই বলছেন, ‘‘উও মুদ্দা খতম হো চুকা।’’ বাইরে থেকে রাস্তার আলো গাড়ির ভিতর মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ছে বটে। তবে কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়। হার্দিক বলছেন, ‘‘মুদ্দা খতম নেহি হোতে। নয়া আতা হ্যায়। অর উসি মুদ্দোপে হি চুনাব লড়া যাতা।’’

Advertisement

আরও পড়ুন, টাইগার প্রভাকরণই আদর্শ, রাজীব হত্যার কারিগরের নামেই ভোট চান এঁরা

পাটিদারদের সংরক্ষণ আন্দোলন দিয়েই তরুণ এই তুর্কির আগমন হয়েছিল গুজরাত রাজনীতিতে। ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন বিজেপি-র। আরও স্পষ্ট করে বললে, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের। গুজরাতের গত বিধানসভা নির্বাচনে তিনি রাজনীতির পালের বেশ খানিকটা হাওয়া নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন। অসহায় অবস্থা থেকে বিজেপি কোনও রকমে সরকার গড়ে মুখ রক্ষা করেছিল। পরে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের কেন্দ্রীয় ঘোষণা হার্দিকের বেলুন কার্যত চুপসে দেয়। হার্দিক নিজে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। ঠিক ছিল জামনগর লোকসভা থেকে কংগ্রেসের টিকিটে লড়বেন। কিন্তু পাটিদার সংরক্ষণের জঙ্গি আন্দোলন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আদালত না বলে দেয়। ফলে তিনি এখন রাজ্য জুড়ে কংগ্রেসের বিভিন্ন প্রচার সভায় যাচ্ছেন। প্রচার করছেন। আর বিজেপিকে উৎখাতের কথা বলছেন।

ঠিক যেমন ভাবে একটু আগে আমদাবাদ পশ্চিম কেন্দ্রের প্রার্থী রাজু ভাই পরমারের হয়ে করলেন। ভিড় ছিল হাজারখানেক জনতার। গুজরাতি ভাষায় হার্দিকের ৩০ মিনিটের ভাষণে হাততালির ঝড় উঠল অন্তত ১৫ বার। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সরকারকে তুলোধোনা করলেন বার বার। সভায় এলেনও একেবারে নিজস্ব স্টাইলে। হুডখোলা জিপের সামনে তিনি বসে। সঙ্গে শ’খানেক যুবক। প্রচারসভার সমস্ত চেঁচামেচির মধ্যে তাদের চিৎকার সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল— দেশকা নেতা ক্যায়সা হো... হার্দিক পটেল জ্যায়সা হো... নামার আগেই প্রচুর যুবক সেই জিপ ঘিরে ধরে কার্যত পাঁজাকোলা করে হার্দিককে নিয়ে এলেন মঞ্চে।


সেই সময়: হার্দিক তখন পাটিদার আন্দোলনের অবিসম্বাদী নেতা।

সাক্ষাৎ চাই... ফোনে অনুরোধ করায় শহরেরই খামাসা এলাকার এই সভাতেই আসতে বলেছিলেন। সময় দিয়েছিলেন রাত ৮টা। নিজে এলেন সওয়া আটটা নাগাদ। মঞ্চের কাছে গিয়ে এক কংগ্রেস কর্মীর হাত দিয়ে নাম লেখা চিরকূট পাঠানোর পর সাক্ষাৎপ্রার্থীর দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। ১০টা নাগাদ সভা শেষ হওয়ার পর একটা ভিড় হার্দিককে তুলে দিল সাদা এই এসইউভিতে। ভিড়ভাট্টা আর ধাক্কাধাক্কি পেরিয়ে কোনও রকমে নিজের মুখটা দেখানো গেল উইন্ড স্ক্রিনের সামনে। কাচ নামিয়ে মুখটা বার করে হার্দিক বললেন, ‘‘পিছে বয়েঠ যাইয়ে।’’ খুলে গেল দরজা। বসা গেল ঠিক তার পিছনেই।

‘‘বলুন কী কথা আছে?’’ আই ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঠিক পিছনে বসে থাকা সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেন। তখনই প্রশ্নটা করা: হার্দিক পটেল ফিনিশড্‌? কয়েক সেকেন্ড পর ভেসে এল গলা, ‘‘আপনি নোট নেবেন কী করে অন্ধকারে? বরং রেকর্ডার অন করুন।’’ করা গেল। তার পর কার্যত টি-টোয়েন্টি স্টাইলে প্রশ্ন আর জবাব—

@ গুজরাতের নির্বাচনী পরিস্থিতি এ বার কেমন?

ভীষণই ভাল পরিস্থিতি। গুজরাতের মানুষ এ বার ঠিক করে ফেলেছেন এখানে পরিবর্তন আনতে হবে। আর সেই পরিবর্তন আনতে কৃষক এবং তরুণ প্রজন্ম পুরোপুরি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেবে। আমি মনে করি, এ বারের নির্বাচন ভীষণই বিষয়ভিত্তিক। সেই বিষয়গুলি হল, তরুণ প্রজন্মের রোজগার চাই। কৃষকের চাই নিজেদের সম্মান। মহিলাদের সুরক্ষা চাই। মুখ্যত এই তিনটি বিষয়কে নিয়েই গুজরাত এবং গোটা দেশে নির্বাচন হচ্ছে।

আরও পড়ুন, জল-মুদি বন্ধ, মোদীর জন্মস্থানেই একঘরে সাত দলিত পরিবার, ভোটেও ‘টোটালি বয়কট’

@ দু’বছর আগে আপনার যে ক্রেজ ছিল, তা এখনও আছে?

আমি ক্রেজ মানি না। ক্রেজ বিষয়ের সঙ্গে হয়। সেই বিষয়ের জন্য লড়াই করতে হয়। ক্রেজ অভিনেতাদের কমে-বাড়ে। নেতাদের নয়। কেন না, নেতা তাঁর কাজ দিয়ে তৈরি হয়ে ওঠেন। ক্রেজ দিয়ে নেতা তৈরি করা যায় না।

@ যে আন্দোলন আপনি শুরু করেছিলেন, এখন তার অবস্থা ঠিক কী রকম?

আমার নিজের ধারণা, ১০ শতাংশ সংরক্ষণ যে কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছে, তা সাধারণ গরিব মানুষের জন্য কার্যকরী হবেই। আমরা সেই সময় সাধারণ মানুষের কথাই বলছিলাম। মানুষ এটা স্বীকারও করেন, হার্দিক পটেলের আন্দোলনের জন্য কোনও একটা সম্প্রদায় নয়, গোটা ভারতে যে গরিব মানুষ আছেন, তাঁদের সংরক্ষণের সুবিধা মিলছে।

@ আপনি কলকাতা গিয়েছিলেন। কেন?

আমি তো কখনও মোদীজিকে জিজ্ঞেস করিনি, আপনি পাকিস্তান কেন গিয়েছিলেন? কলকাতা এই দেশেরই অংশ। সেই অংশের ভাই-বন্ধু-বোনেদের কাছে যাওয়া নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যায় না। এটা কোনও প্রশ্নই নয়।

আরও পড়ুন, গোটা গাঁধীনগরে একটা ছবিও নেই, আডবাণীকে শুধু পাওয়া গেল বিজেপি অফিসে প্রেস রুমের দেওয়ালে

@ আপনি কংগ্রেসে যোগ দিলেন। মানুষ কী বলছে?

লোক কী বলছে, কী বলবে তা জানি না। আমি যদি বিজেপিতে যেতাম, তা হলে কি পদ্মভূষণ সম্মান দিয়ে দেওয়া হত! কংগ্রেসে যাওয়ার কারণ তো আছেই। সুভাষচন্দ্র বসু তো আপনার রাজ্যের। উনি কোন দলের সভাপতি ছিলেন? কংগ্রেসেরই তো। আমার গুজরাতে সর্দার বল্লভভাই পটেল বা মহাত্মা গাঁধী কংগ্রেসেই তো ছিলেন। এই পার্টিতে যাওয়া ছাড়া আর কোথায় যেতাম।

@ গুজরাতে কী ফল হবে?

এখানে ১৫টা আসন আমরা পাব।

@ আর গোটা দেশে?

দেশে সরকার তো আমরাই বানাচ্ছি।

কী বললেন হার্দিক? শুনে নিন...

@ নরেন্দ্র মোদী আপনার রাজ্যের। কী বলবেন ওঁকে নিয়ে?

মোদীজিকে সিরিয়াস নেতা এখন আর মনে করি না। আগে মনে করতাম। উনি যা যা বলেন, সব মিথ্যে কথাই বলেন।

@ আচ্ছা যে পাটিদাররা আপনার সঙ্গে ছিল, তাঁরা কি এখনও আপনার সঙ্গে আছে?

এই গাড়িতে বসে সেটা আপনাকে কী করে বোঝাব! মাঠে ময়দানে চলুন। নিজেই বুঝতে পারবেন। এটা এই শহরের গাড়িতে বসে বোঝা যায় না।

আরও কিছু কথা চলল। তার পর নেহরু নগরের মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল টয়োটা ফরচুনা। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘‘কোথাও কোনও প্রয়োজন হলে ফোন করবেন।’’ ‘অফ দ্য রেকর্ড’ আর ‘অন দ্য রেকর্ড’ এই দুই মোডে যেন দু’রকম হার্দিক।

চলে যাওয়ার আগে বছর পঁচিশের ওই তরুণ তুর্কিকে আর জানানো হল না, মেহসানার কৃষক মফতলাল পটেল কী বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘পটেলদের বিশ্বাসের সঙ্গে খেলা করেছেন হার্দিক। ওঁর কংগ্রেসে যোগ দেওয়া ঠিক হয়নি। বিশ্বাসঘাতক। নিজের স্বার্থের জন্য গোটা সম্প্রদায়কে ব্যবহার করেছেন।’’ উত্তর গুজরাতের মফতলালের মতো দক্ষিণ গুজরাতের সুরাতেও প্রায় একই কথা শোনা গিয়েছিল পঙ্কজ পটেলের মুখে। ‘‘একটা ছেলের কিছুই ছিল না। সেখান থেকে এখন কী কী হয়েছে! কী ভাবে হল, পারলে জিজ্ঞেস করুন।’’

আমদাবাদ শহরও হার্দিককে নিয়ে একই প্রশ্ন তুলছে, সেটাও জানানো গেল না। অমিত পটেল আদতে সৌরাষ্ট্রের বাসিন্দা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘টয়োটা ফরচুনার গাড়ি, বৈষ্ণোদেবী সার্কলে গ্রিনউড বাংলো— এ সব নিয়ে মানুষ তো প্রশ্ন তুলবেই। পটেলদের মধ্যে ওঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রায় নেই বললেই চলে। কিছু তরুণ আজও ওঁর সঙ্গে আছে বটে। তবে...’’ না, আর কিছু ভাঙলেন না।

হার্দিক, এ প্রশ্নগুলো যে উঠছে আপনি নিশ্চয়ই জানেন! আর উত্তরও আপনার জানা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement