পিনারাই বিজয়ন
দীর্ঘ কালের রেওয়াজ ভেঙে গেল কেরলে। নতুন নজির গড়ে দক্ষিণী ওই রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরল বামেরা। পিনারাই বিজয়নই হলেন প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর নেতৃত্বে প্রথম কোনও সরকার রাজ্যে প্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারল।
বুথ-ফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত ছিল। দলের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে সিপিএমও ভোটের পরে জয়ের হিসেবই করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভোটের প্রকৃত ফল সেই হিসেবকেও ছাপিয়ে গিয়েছে! নির্বাচন কমিশন সূত্রে যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার নিরিখে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন এলডিএফ এগিয়ে ৯৯টি আসনে। ইতিহাস গড়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই জয় কেরলের মানুষের। আমরা মানুষের উপরে বিশ্বাস করি। তাঁরাও আমাদের বিশ্বাস করেছেন।’’
মোট ১৪০ আসনের কেরল বিধানসভায় বাকি ৪১টি আসনে এগিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ। গোটাতিনেক আসনে বিজেপি ভাল লড়াই দিলেও তারা এগোতে পারেনি কোনও কেন্দ্রেই। পাঁচ বছর আগে এলডিএফ ক্ষমতায় এসেছিল ৯১ আসনে জিতে, এ বার তার চেয়ে আসন বাড়িয়েছে তারা। ইউডিএফের আসন গত বারের চেয়ে কমে গিয়েছে।
দু’বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে কেরলে ২০টির মধ্যে ১৯টি আসনেই জিতেছিল কংগ্রেস। মাত্র একটি আসন ছিল সিপিএমের দখলে। সেই জায়গা থেকে দেখলে, দু’বছরের মধ্যে সিপিএম তথা বামেরা যেমন প্রবল ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, তেমনই বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে কংগ্রেসকে। কেরলের ওয়েনাড় থেকে ২০১৯ সালে লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন রাহুল গাঁধী। এ বার বিধানসভা ভোটেও কেরলে চুটিয়ে প্রচার করেছেন তিনি, সময় দিয়েছেন অনেকটা। জাতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধিতার রাজনীতিতে পাশাপাশি বা বাংলায় জোট করে লড়লেও কেরলে কংগ্রেস নেতা রাহুল এ বার তীব্র আক্রমণ করেছেন বামেদের। কিন্তু ভোটের বাক্সে দেখা যাচ্ছে, ওয়েনাড় জেলার তিনটি আসনে সাফল্য পেলেও গোটা রাজ্যে সার্বিক ভাবে কংগ্রেসের ফ্রন্ট ইউডিএফের বিশেষ লাভ হয়নি।
বাংলায় নির্বাচনী মানচিত্র থেকে বামেদের একেবারে মুছে যাওয়ার দিনে কেরলে বিজয়নদের সাফল্যকে প্রত্যাশিত ভাবেই আঁকড়ে ধরেছেন সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাটেরা। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরির কথায়, ‘‘কেরলের মানুষকে সেলাম! এই সঙ্কটের সময়ে তাঁরা পথ দেখিয়েছেন। বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, করোনার মতো অতিমারী মোকাবিলা হোক বা সংবিধানের আদর্শ রক্ষায় এলডিএফ সরকার যে ভাবে কাজ করেছেন, তার উপরে মানুষ আস্থা রেখেছেন। আর্থ-সামাজিক ভাবে যে বিকল্প ভারতের দরকার, কেরলে বাম সরকার সেই চেষ্টাই করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।’’ দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক কারাটেরও বক্তব্য, ‘‘গত ৪০ বছরে কেরলে কোনও সরকার পরপর দু’বার ক্ষমতায় আসেনি। এই ফল থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বিজয়নের নেতৃত্বাধীন সরকার যে ভাবে বন্যা ও কোভিড মোকাবিলা করেছে এবং জনমুখী উন্নয়ন করেছে, মানুষ তার পাশে দাঁড়িয়েছেন।’’
নিজেদের প্রত্যাবর্তনের পাশাপাশিই গেরুয়া শিবিরকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কেরলের সিপিএম নেতৃত্ব। রাজ্যের বিদায়ী অর্থমন্ত্রী এবং সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য টমাস আইজ়্যাকের মতে, ‘‘আমরা কেরলে বিজেপিকে শূন্যে নামানোর ডাক দিয়েছিলাম। মানুষ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। গত বার বিজেপি একটি আসনে জিতেছিল, এ বার সেটাও হারিয়েছে।’’ ধর্মাদম কেন্দ্র থেকে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন যেমন জয়ী হয়েছেন, তেমনই মাত্তান্নুরে প্রায় ৬৩ হাজার ভোটে জিতেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা। কেরলের বিধানসভা ভোটের ইতিহাসে যা বৃহত্তম ব্যবধান। করোনা-সহ স্বাস্থ্য বিপর্যয় মোকাবিলায় শৈলজার দক্ষতা সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক মহলেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিরোধী শিবিরের মধ্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উম্মেন চান্ডির পাশাপাশি জয়ী হয়েছেন বিরোধী দলনেতা রমেশ চেন্নিতালাও। লোকসভার পরে ফের পরাজয়ের মুখে পড়তে হয়েছে বিজেপির রাজ্য সভাপতি কে সুরেন্দ্রনকে।