স্বয়ং সাধারণ সম্পাদক মানছেন, বিজেপি এখনও বড় বিপদ। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঢিলে দেওয়া চলবে না। কিন্তু সেই লড়াইয়ের বৃহত্তর মঞ্চ গড়ার লক্ষ্যে বিশেষ এগোতে পারছে না তাঁর দল। ছোট বাম দলগুলির চাপ হাত বেঁধে রাখছে সীতারাম ইয়েচুরির!
বামেদের দুই শক্ত ঘাঁটি কেরল ও ত্রিপুরায় সাম্প্রতিক উপনির্বাচনের ফল দেখে নতুন করে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ইয়েচুরি। দুই রাজ্যেই উপনির্বাচনে জয় না পেলেও ভাল রকম উত্থান ঘটেছে বিজেপি-র! যারা কেরল ও ত্রিপুরায় এত দিন তেমন দাগ কাটতে পারেনি। দুই রাজ্যেই ধাক্কা লেগেছে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে। এই ফলাফল দেখেই দলের রাজনৈতিক লাইন ও কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে চাইছেন ইয়েচুরিরা। কিন্তু হাতের সামনে এমন দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও বিহারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের জন্য জনতা পরিবার বা কংগ্রেসের যৌথ মঞ্চের হাত না ধরারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বামেরা! দিল্লিতে রবিবার ইয়েচুরি ও প্রকাশ কারাটের উপস্থিতিতে ৬ বাম দলের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, বিহারে বামেরা একটি ‘যৌথ ও স্বাধীন ব্লক’ হিসাবে ল়ড়বে। এই সিদ্ধান্ত বিহারে বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগাভাগি করে প্রকারান্তরে নরেন্দ্র মোদীর দলের বিরুদ্ধে লড়াইকে দুর্বল করবে বলেই সিপিএমের একাংশের আশঙ্কা।
সিপিএমের মধ্যে যখন বিজেপি-বিরোধী লড়াইকে আরও জোরালো করার দাবি উঠছে, সেই সময়েই বাম শরিক সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং বামফ্রন্টের বাইরে এসইউসি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের সঙ্গে মিলে অন্য রকম সিদ্ধান্ত হওয়ায় প্রশ্ন তুলছেন ইয়েচুরির নিজের দলের নেতাদেরই একাংশ। বিশেষত, বঙ্গ সিপিএমের একাংশ এই ঘটনায় রীতিমতো বিস্মিত! তাঁদের মতে, বিহারে দীর্ঘ দিনের সংঘাত ভুলে শুধু বিজেপি-র মোকাবিলার জন্যই একজোট হয়েছেন নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদেরা। সংযুক্ত জনতা পরিবারকে বাইরে থেকে সমর্থন দিচ্ছে কংগ্রেসও। এই অবস্থায় তাদের সঙ্গে আলোচনায় গিয়ে অভিন্ন মঞ্চ গড়তে পারলে বিজেপি-বিরোধী ভোটকে এক জায়গায় আনা যেত। বিহারে শুধু বাম দলগুলি মিলে একসঙ্গে লড়তে গিয়ে শোচনীয় ফলাফল হয়েছিল গত বছর লোকসভা ভোটের পরেই ১০টি আসনের বিধানসভা উপনির্বাচনে! তার পরেও একই গণ্ডিতে নিজেদের বেঁধে ফেলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এ রাজ্য থেকে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলছেন, ‘‘বিহারে সব ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি একজোট হয়ে বিজেপি-কে হারাতে পারলে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে একই রকম মঞ্চ গড়ার চাপ আসত। তবে বিহারের এই শুধু বাম মডেল ব্যর্থ হলেও বাংলায় নতুন করে ভাবতে হবে!’’
দিল্লিতে আজ থেকে শুরু হতে চলা সিপিএমের পলিটব্যুরোর বৈঠকে কেরল ও ত্রিপুরার নেতৃত্ব অবশ্য বিজেপি-বিরোধী রিপোর্টই নিয়ে যাচ্ছেন। ত্রিপুরায় দু’টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনেই সিপিএম জিতেছে ভাল ব্যবধানে। কিন্তু কংগ্রেসকে সরিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বিজেপি। আবার কেরলের আরুবিক্কারা আসনে কংগ্রেসের কাছে ১০ হাজার ভোটে সিপিএম হারলেও বিজেপি-র ভোট বেড়েছে ভাল রকম। দিল্লিতে এ দিন সুধাকর রেড্ডি, ডি রাজা, অবনী রায়, জি দেবরাজন, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এবং এসইউসি-র সত্যবানদের সঙ্গে বৈঠকের আগে শনিবারই কোঝিকোড়ে গিয়েছিলেন ইয়েচুরি। সেখানেই কেরল সিপিএমের নেতৃত্ব তাঁকে প্রাথমিক ভাবে জানিয়েছেন, রাজ্যের ওই আসনে বামেদের ভোট ৭% কমেছে। কিন্তু জয়ী হলেও কংগ্রেসের ভোট কমেছে ১০%! আর বিজেপি-র ভোট ১৫%-এরও বেশি বেড়ে ২৩% হয়েছে। কেরল সিপিএম নেতৃত্বের ধারণা, শুধুমাত্র রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধেই তাঁরা বেশি সরব হয়েছিলেন। বিজেপি-র বিরুদ্ধে সুর ছিল তুলনায় নরম। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই কৌশল পাল্টাতে হবে।
উপনির্বাচনের এই প্রবণতা দেখেই ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘সারা ভারত কেরলকে খুব প্রগতিশীল রাজ্য বলেই জানে। সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এত দূর এগিয়ে গিয়েছে মানে বিষয়টা নিয়ে খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।’’ ইয়েচুরি উল্লেখ করেছেন, উপনির্বাচনে সাধারণত ক্ষমতাসীন দলই জেতে। কিন্তু কংগ্রেস-বিরোধিতার সুর চ়ড়াতে গিয়ে বিজেপি-র সুবিধা করে দেওয়ার দিকটি নিয়েও ভাবার কথা বলেছেন। দিল্লিতে ৬ বাম দলের বৈঠকে আগামী ২০ জুলাই দেশ জুড়ে ‘দুর্নীতি-বিরোধী দিবস’ পালনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। সেই দিন বামেদের প্রতিটি রাজ্য শাখাকে বিজেপি-র সুষমা স্বরাজ, বসুন্ধরা রাজে, শিবরাজ
সিংহ চৌহান, রমন সিংহদের বিরুদ্ধে পথে নামার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই তাগিদকে নির্বাচনী মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার পথে পুরনো ছকে বাঁধা পড়তে হচ্ছে কেন, প্রশ্ন এখন সিপিএমের অন্দরেই!