ফাইল চিত্র।
রাস্তা-ঘাটে, মাঠে-দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে পোস্টার বা ফ্লেক্স। সামাজিক মাধ্যমও ছেয়ে ফেলা হয়েছে একই প্রচারে। যেখানে আবেদন জানানো হচ্ছে, ‘ভরসা রাখুন ক্যাপ্টেন-এর উপরে।’’ দেশে একমাত্র বাম-শাসিত সরকার ধরে রাখতে ‘ক্যাপ্টেন’কে সামনে রেখেই এ বার লড়াই বামেদের।
সমাজ কল্যাণের নানা প্রকল্প এবং বিশেষত, করোনা ও লকডাউনের সময়ে পিনারাই বিজয়নের এলডিএফ সরকার যে কাজ করেছে, তার সুবাদেই কেরলে এ বার প্রত্যাবর্তনের আশা করছে সিপিএম। পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলানোই দক্ষিণী এই রাজ্যের রেওয়াজ। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এলডিএফ সরকারের কাজ এবং একের পর রোগের হানা সামাল দিতে তাদের ‘দক্ষতা’র জোরেই সেই বদলের ধারায় ব্যতিক্রম আনা সম্ভব বলে মনে করছেন সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাটেরাও। বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে যে সব জনমত সমীক্ষা হয়েছে, তার প্রায় সবক’টিতেই করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের ভূমিকায় আস্থা রাখার কথা বলেছেন গড়ে ৫০%-এর বেশি মানুষ। কেরলে তাই চাকা ঘোরানোর আত্মবিশ্বাস পাচ্ছে বাম শিবির।
বিজয়নকে সামনে রেখে লড়াই হলেও ‘ক্যাপ্টেন’ অভিধায় দলের মধ্যে বিতর্ক আছে। কোডিয়ারি বালকৃষ্ণন, ই পি জয়রাজন, পি জয়রাজনের মতো দলের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য নেতারা বলছেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে ‘ব্যক্তিপুজো’র চল নেই। ক্যাপ্টেন তো দলই। এই প্রচার দলের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়, সমর্থকদের কাজ। স্বয়ং বিজয়ন অবশ্য বলেছেন, মানুষ তাঁকে কী নামে ডাকবেন, সেটা মানুষের ব্যাপার। তাঁদের লক্ষ্য, রাজ্যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ বজায় রাখা। বিজয়নের কথায়, ‘‘গত বার নেমম কেন্দ্রে বিজেপি খাতা খুলেছিল। এ বার সেই অ্যাকাউন্টও মানুষ বন্ধ করে দেবেন!’’
দু’বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে কেরলে ২০টি আসনের মধ্যে মাত্র একটিতে জয়ী হয়েছিল এলডিএফ। বাকি ১৯টিই গিয়েছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফের দখলে। সেই ফলাফলকে বিধানসভা কেন্দ্রের নিরিখে ভাঙলে শাসক এলডিএফ এগিয়ে ছিল মাত্র ১৬টি আসনে। ইউডিএফের ‘লিড’ ছিল রাজ্যের মোট ১৪০ আসনের মধ্যে ১২৩টিতে। কিন্তু গত ডিসেম্বরে পুরসভা, পঞ্চায়েত-সহ স্থানীয় প্রশাসনের ভোটের ফলের নিরিখে বামেদের ‘লিড’ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০১ আসনে। ইউডিএফ এগিয়ে ৩৮টিতে এবং বাকি একটিতে বিজেপি। আর ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের হিসেব ধরলে, তখন বামেরা ক্ষমতায় এসেছিল ৯১ আসনে জিতে। সেই ৯১ থেকে ১৬-য় নেমে গিয়ে আবার স্থানীয় ভোটের ভিত্তিতে ১০১ আসনে এগিয়ে যাওয়া— এই ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনিও বাম শিবিরকে বিধানসভা ভোটে উজ্জীবিত রাখছে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার পালে যাতে বেশি বাতাস না লাগে, সে দিকে নজর রেখে টানা দু’বারের বেশি জিতেছেন এমন বিধায়কদের এ বার আর প্রার্থী করেনি সিপিএম। এই নীতি মানতে গিয়ে টিকিট পাননি পাঁচ মন্ত্রী-সহ অন্তত ২৩ জন বিধায়ক।
হাল ছাড়েনি কংগ্রেসও। সাম্প্রতিক কালের সোনা পাচার-কাণ্ডের সঙ্গে যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের নাম জডিয়েছে, সেই প্রসঙ্গকে টেনে দুর্নীতির অভিযোগে বাম সরকারকে নিশানা করছে ইউডিএফ। কেরলের ওয়েনাড় থেকে সাংসদ হওয়ার পরে রাহুল গাঁধীও এ বার বিস্তর সময় দিয়েছেন এই রাজ্যের প্রচারে। কেরলে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরলে ‘ন্যায়’ প্রকল্পে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবার পিছু মাসে ৬ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা করার পাশাপাশিই রাহুল অভিযোগ করেছেন, অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে বাম সরকার। এমনকি, ‘‘মোদী কেন কখনও সিপিএম-মুক্ত ভারতের কথা বলেন না’’— এমন মন্তব্যও করেছেন রাহুল! বাংলায় যখন কংগ্রেস বামেদের হাত ধরে লড়াই করছে, সেই সময়ে রাহুলের এমন মন্তব্য কত দূর বিবেচনার পরিচয়, সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে সিপিএমের অন্দরে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতারাও মনে করছেন, কেরলের বাধ্যবাধকতা মেনে স্থানীয় বিষয়ে রাহুল কথা বলতেই পারেন কিন্তু মোদীর প্রসঙ্গ এনে বামেদের প্রতি আক্রমণাত্মক হলে পরে বাংলায় এসে জোটের পক্ষে প্রচার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হবে কী ভাবে!
বিজয়ন, বালকৃষ্ণনেরা অবশ্য কংগ্রেসকে আক্রমণ ফিরিয়ে দিয়ে বলছেন, বিজেপির সঙ্গে তাদের সুর মিলে গিয়েছে, ‘গোপন সমঝোতা’ও হয়েছে। শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকার প্রসঙ্গে বামেদের প্রতি বিজেপি ও কংগ্রেসের যৌথ আক্রমণ এই প্রচারে আরও ইন্ধন দিয়েছে। আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেরলে গিয়ে বলেছেন, ‘‘শীঘ্রই কমিউনিস্ট কংগ্রেস পার্টি দেখা যাবে!’’ রাজ্যে ক্ষমতায় ফেরার দৌড়ে কংগ্রেস যত বামেদের নিশানা করছে, বামেরা ততই তাদের বিজেপির সঙ্গে এক বন্ধনীতে ঠেলে দিচ্ছে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বিগত লোকসভা ভোটে বামেদের বিপর্যয় হলেও বিজেপি তেমন দাগ কাটতে পারেনি কেরলে, ফায়দা পেয়েছিল কংগ্রেস। এ বার বিজেপি কেমন ভোট পায়, তার উপরে অনেক আসনেরই ফল নির্ভর করবে। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার দাবি, কেরলে তাঁরা আগের চেয়ে অনেক ভাল করবেন। আর দলের রাজ্য সভাপতি পি সুরেন্দ্রনের দাবি, ‘‘বাম ও কংগ্রেস পালা করে রাজ্যে লুঠের জমানা চালায়, এই সত্য এখন কেরলের মানুষ ধরে ফেলেছেন!’’
পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন— কোন রাস্তায় কেরল হাঁটবে, তা ঠিক করতে কাল, মঙ্গলবার রাজ্যের ১৪০ কেন্দ্রেই ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন মানুষ।