মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতি জি আর স্বামীনাথন। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতীয় আইন অনুযায়ী কোনও অপরাধীকে ক্ষমা করার ভিত্তিটি নিহিত রয়েছে বাল্মীকি রচিত রামায়ণে— তা সে সংবিধানের ৭২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনও আসামিকে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করাই হোক, কিংবা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৩২ ধারা মোতাবেক সাজা মকুব হওয়াই হোক। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আইনজীবী শাখা অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদের জাতীয় সম্মেলনে এই কথা বলেছেন মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতি জি আর স্বামীনাথন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনের বদলে দেশের আইন ব্যবস্থার ‘ভারতীয়করণ’-কে সময়ের দাবি বলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস আব্দুল নাজ়ির গত বছর যে মন্তব্য করেছিলেন, তাকে জোরদার সমর্থনও করেছেন তিনি।
হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই আইনজীবী সংগঠনের সম্মেলনে গত কাল ‘৭৫ বছরের পুনরুত্থিত ভারত: সময় এসেছে ভারতীয় আইনশাস্ত্রের’ শীর্ষক এক বক্তৃতা দেন বিচারপতি স্বামীনাথন। বলেন, রাজীব গান্ধীর হত্যাকারীরা ছাড়া পাওয়ায় এবং তাদের এক জন (পেরারিভালন) চেন্নাইয়ের একটি সম্মেলনে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ পাওয়ায় অনেকের মতো তিনিও বিচলিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে বাল্মীকির রামায়ণের একটি শ্লোক তাঁর মনে পড়ে। সেখানে সীতা হনুমানকে বলেছিলেন, কেউ ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। তাই কেউ অত্যাচার করলেও প্রত্যাঘাতের বদলে ক্ষমার কথা ভাবা উচিত। বিচারপতি স্বামীনাথন বলেন, ‘‘এই অসাধারণ শ্লোকটি পড়েই আমি ওই ছয় আসামিকে ক্ষমা করার বিষয়টি মেনে নিতে পেরেছিলাম। বুঝেছিলাম, ৭২ নম্বর অনুচ্ছেদ কিংবা ৪৩২ ধারা— এ সবেরই মূলে আছে বাল্মীকির রামায়ণ।’’ এর পরেই শ্রোতাদের তিনি বলেন, আইন ব্যবস্থার ভারতীয়করণ নিয়ে বিচারপতি নাজ়িরের বিবৃতি নিজেদের মাতৃভাষায় অনুবাদ করে তা বিতরণ করতে। বলেন, ‘‘ওই সময়ে একটি নিবন্ধের শিরোনাম হয়েছিল, ‘অবজেকশন ইয়োর অনার’। আমরা আজ এখানে হাতুড়ি ঠুকে বলতে এসেছি, ‘অবজেশন ওভাররুলড’।’’
বিচারপতি স্বামীনাথন জানান, ১৯৯৪ সালে অধিভক্ত পরিষদের সম্মেলনে যখন তিনি বলতে এসেছিলেন, তখন কাশ্মীরে জঙ্গি-সমস্যা তুঙ্গে। ওই সম্মেলনের দিন কয়েক আগে কয়েক জন জঙ্গি একটি মসজিদে ঘাঁটি গেড়ে বসে বলেছিল, নিরাপত্তা বাহিনী ঢুকলেই তারা মসজিদ উড়িয়ে দেবে। এই প্রসঙ্গেই বিচারপতি স্বামীনাথন বলেন, ‘‘এই তো ওদের নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার নমুনা। তখন রমজ়ান মাস চলছিল। ভুলে গিয়েছি, ওই সময়ে কোনও এক আদালত ওই জঙ্গিদের বিরিয়ানি খাওয়ানোর আদেশ দিয়েছিল।’’ এমন ‘বিরিয়ানি আইনশাস্ত্র’ কোথাও দেখেননি বলে সে বার তিনি মন্তব্য করেছিলেন বলে বিচারপতি জানান। একই সঙ্গে বলেন, ‘‘তা সত্ত্বেও গত ২৮ বছরে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আমি ভাগ্যবান যে, আইনশাস্ত্রের ভারতীয়করণ নিয়ে আজ কথা বলতে পারছি।’’ তাঁর মতে, অন্ধ ভাবে না হলেও বর্তমান সময়ের চাহিদা মতো দেশের আইনি ব্যবস্থায় পরিবর্তন না করার কিছু নেই।
সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সঙ্গে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজুর ‘দ্বন্দ্বের’ প্রসঙ্গও টেনেছেন বিচারপতি স্বামীনাথন। তিনি জানান, মাদ্রাজ হাই কোর্টে নতুন প্রধান বিচারপতি এলেই বার অ্যাসোসিয়েশন স্বাগত ভাষণে এক তামিল রাজার কথা বলে, যিনি ভুল করে এক চোরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন বুঝতে পেরে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিচারপতি বলেন, ‘‘ওই কথাটা শুনলেই মনে হয়, বিচার বিভাগের ভুল না করাটা ঈশ্বরের কৃপায় আর এই পেশার শর্ত নয়। না হলে কলেজিয়ামকে দিনরাত একের পর এক নাম সুপারিশ করে যেতে হত। ধরে নিচ্ছি সে ক্ষেত্রে প্রথমত, কলেজিয়ামের সদস্যদের অমর হতে হত। এবং দ্বিতীয়ত, আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজুকে কলেজিয়ামের সঙ্গে রেষারেষি করতে হত না।’’ ভারতের আইন ব্যবস্থা ও সংবিধানে বিভিন্ন দেশের উপাদানের সমাহার ঘটেছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমি বাজনায় ভারতীয় সুর বাজানোতেই আমাদের মুন্সিয়ানা।’’