মঙ্গলবার রাত সাড়ে এগারোটা। চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, সুষমা স্বরাজ আর নেই। কিন্তু চিকিৎসকদের ঘোষণা তখনও বাকি। আকবর রোডে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক থেকে বেরোচ্ছেন সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী, গুলাম নবি আজাদ। প্রথম প্রশ্ন ছুটে গেল তাঁদের কাছে: ‘‘সুষমা স্বরাজের খবর শুনেছেন?’’ ওঁরা তখনও ভাবছেন, উড়ো খবর! আজাদের দিকে তাকালেন সনিয়া। আজাদ বললেন, ‘‘ভুল। ভুল। ভুল। হতেই পারে না। আমার বোনকে নিয়ে এ সব খবর প্রচার করবেন না।’’ সনিয়াও বললেন, ‘‘আমি কিছু বলব না।’’
এআইসিসি থেকে আজাদকে সোজা এমসে পাঠালেন সনিয়া। ততক্ষণে সব শেষ। কে বলবে, এই সনিয়া গাঁধীর সঙ্গেই দুই দশক আগে বল্লারীতে লড়ে হেরে যান সুষমা? সনিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে নিজের মাথা কামিয়ে নেবেন বলেছিলেন তিনি?
সনিয়া প্রধানমন্ত্রী হননি। কিন্তু দুই নেত্রীর তিক্ততা তার অনেক আগেই দূর হয়েছিল। আজ সকাল হতেই সুষমার বাড়িতে গেলেন সনিয়া। মন্ত্রী না হওয়ার পর সরকারি বাংলো ছেড়ে যন্তর-মন্তরের কাছে একটি আবাসনের পাঁচ তলায় থাকছিলেন সুষমা। কাল রাতে এমস থেকে সেখানেই নিয়ে আসা হয় মরদেহ। সনিয়া সবে উপরে উঠেছেন, তখনই পৌঁছলেন অমিত শাহ। মুখোমুখি দু’জনে। তার ফাঁকেই সুষমার স্বামী স্বরাজ কৌশল, মেয়ে বাঁশুরির সঙ্গে কথা বললেন। রাহুল গাঁধী গেলেন আরও খানিক পরে। পরে স্বরাজ কৌশলকে একটি আবেগঘন চিঠিও লিখলেন দু’জনে।
সব কিছু কিন্তু ঠিকই চলছিল সুষমার। লোকসভায় ৩৭০ বিলোপ পাশ হতে দেখছিলেন টেলিভিশনে। টুইটও করলেন। খোশমেজাজেই ছিলেন। রাত ন’টা নাগাদ হঠাৎ বুকে অস্বস্তি। আধ ঘণ্টার মধ্যে এমসে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। ফেরানো গেল না। তিন ঘণ্টা পর সেই বাড়িতেই ফিরে এল সুষমার নিথর দেহ। লাল শাড়িতে মাকে সাজিয়ে দিলেন মেয়ে। নেতা-আম জনতা মাঝরাতেই বাড়িতে আসা শুরু করেছেন। মায়ের পাশে চেয়ার নিয়ে কৌশল আর বাঁশুরি বসে। ঘর ভর্তি লোক। বাঁশুরি হাঁক দিলেন, ‘‘সব আলো জ্বালিয়ে দাও, এসি-পাখা চালাও আর রাধেশ্যামের মূর্তিটা মায়ের মাথার কাছে রাখো।’’
সারারাত ঘুম নেই। শুধু বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাই নন, বিরোধী দলের নেতারা দলে দলে আসছেন। মায়াবতী পৌঁছে গিয়েছেন সকাল সাড়ে ছ’টায়। সমাজবাদী পার্টির রামগোপাল যাদব গিয়ে হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেললেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চোখেও জল। যে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে ‘গুরু’ মানতেন সুষমা, কেঁদে ফেললেন তিনিও। তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল, শরদ যাদব— বিরোধী নেতাদের ভিড়ই যেন বেশি। কেউ বলছেন, আমার ‘দিদি’র মতো, কেউ বলছেন ‘বোন’, কেউ নিজের ‘মা’কে দেখেন সুষমার মধ্যে। ভাল বক্তা, সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা, বিদেশ মন্ত্রকে মানবিক স্পর্শের থেকেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথাই বেশি করে উঠে এল স্মৃতিচারণে।
দুপুর বারোটা। বাড়ি থেকে মরদেহ এল বিজেপি দফতরে। বিজেপির পতাকায় সুষমার মরদেহে মুড়ে দিলেন অমিত শাহ। আরএসএসের নেতারাও হাজির। আরও তিন ঘণ্টা ধাক্কাধাক্কি। শুধু শেষ দেখার জন্য। বিজেপি নেতা হরিশ খুরানা বললেন, ‘‘এক বছরের মধ্যে দিল্লির তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চলে গেলেন। আমার বাবা মদনলাল খুরানা, কিছু দিন আগে শীলা দীক্ষিত আর কাল সুষমাজি।’’
বেলা তিনটে। শেষযাত্রার সময়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হবে শেষকৃত্য। জাতীয় পতাকায় ঢাকা হল দেহ। চোখে জল নিয়ে স্যালুট করলেন স্বরাজ কৌশল আর বাঁশুরি। রাজনাথ সিংহ, জে পি নড্ডা, শিবরাজ সিংহ চৌহান, পীযূষ গয়াল কাঁধে তুলে নিলেন সতীর্থকে। শেষবারের মতো। লোদী রোডের শ্মশানে ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন অমিত শাহ। ভুটানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, শাসক-বিরোধী দলের নেতারাও উপস্থিত। এলেন প্রধানমন্ত্রীও। বাঁশুরিই করলেন মুখাগ্নি। ৯১ বছরের আডবাণীর হাত ধরলেন প্রধানমন্ত্রী। নিয়ে গেলেন গাড়ি পর্যন্ত।
তবুও আক্ষেপ থেকে গেল অনেকের। সুষমা যাঁদের কথা রাখলেন না। আডবাণীর আক্ষেপ, জন্মদিনে তাঁর পছন্দের ‘চকোলেট কেক’ আর আনবেন না সুষমা। স্মৃতি ইরানির আক্ষেপ, বাঁশুরির পছন্দের এক রেস্তঁরায় একসঙ্গে আর খাওয়া হবে না। উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নায়ডুর আক্ষেপ, সামনের সপ্তাহে আর রাখি পরাতে আসবেন না ছোট বোনটি। প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশির আক্ষেপ, সুষমা প্রধানমন্ত্রী হলেন না, তাই তাঁরও প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি হওয়া হল না!