বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ফোন এল কলকাতা বিমানবন্দরের ম্যানেজারের ঘরে। ‘‘সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হতে যাচ্ছে কলকাতা বিমানবন্দর। যাত্রী সেজে পাঁচ জন বিমানবন্দরের টার্মিনালের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তাদের সঙ্গে বোমা আছে। দু’টি বোমা তারা ইতিমধ্যেই সক্রিয় করে ফেলেছে। আরও একটি বোমা রাখার কাজ চলছে।’’
ম্যানেজারের টেবিলের উপরে রাখা ফোনের সিএলআই বলছে, ফোনটি করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের মথুরা থেকে। গত কাল গভীর রাতে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা ছিল মুম্বই বিমানবন্দরে। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই ফোন! ঝুঁকি নেওয়ার রাস্তাতেই যেতে চাননি কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। দ্রুত বৈঠকে বসে যান সিআইএসএফ, বিভিন্ন বিমানসংস্থার নিরাপত্তারক্ষী, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা। পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে ‘বম্ব থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট কমিটি’ বুঝতে পারে এই বোমা ফাটার হুমকি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও ঝুঁকি না নিয়ে তল্লাশি শুরু হয় গোটা টার্মিনাল জুড়ে। সমস্ত সংস্থার প্রতিনিধিদের সেই কাজে সামিল করা হয়। নিয়ে আসা হয় স্নিফার ডগ। বিমানবন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে, এর জন্য কোনও বিমান ছাড়তে দেরি হয়নি। সেই সময়ে যে যাত্রীরা টার্মিনালে ছিলেন তাঁদেরও বাইরে বার করার প্রয়োজন হয়নি। মথুরা থেকে আসা নম্বরটি পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। যোগাযোগ করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের পুলিশের সঙ্গে।
কলকাতার পাশাপাশি অনেকটা একই ধাঁচে সোমবার গভীর রাতে মুম্বই বিমানবন্দরে জঙ্গি হামলা হবে বলে ফোন আসে বিমানবন্দরের ম্যানেজারের ঘরে। এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি দেশীয় ও আন্তর্দেশীয় বিমানবন্দর ছাড়াও হামলার নিশানায় রয়েছে তাজ হোটেল। বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি করে ওই সব জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটানো হবে বলেও জানানো হয় ফোনে। তার পরেই মুম্বই বিমানবন্দর ও তাজ হোটেলের নিরাপত্তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় মুম্বই পুলিশ। সতর্ক করে দেওয়া হয় দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরকে। এর সঙ্গে কলকাতা বিমানবন্দরে আসা হুমকির কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি না, খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
সামনেই উৎসবের মরসুম। নাশকতার মাত্রা বাড়াতে সাধারণত এই মরসুমকেই হামলার জন্য বেছে নেয় পাক জঙ্গিরা। এ বার অবশ্য এক ধাপ এগিয়ে আসন্ন দুর্গাপুজো ও দিওয়ালিতে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের জঙ্গিরা হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, জঙ্গি নিশানায় রয়েছে দিল্লি ও রাজস্থান। ক্ষয়ক্ষতি ঘটানোর চেয়ে মূলত ভারতে তাদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আইএস হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে বলে তথ্য এসেছে কেন্দ্রের হাতে।
সরকারি ভাবে এ দেশে আইএসের সাংগঠনিক উপস্থিতি রয়েছে বলে অবশ্য মানতে চায় না কেন্দ্র। কিন্তু গোয়েন্দাদের মতে, দেশের প্রায় বারোটি রাজ্যে আইএসের সমর্থক রয়েছে। মূলত এগুলি দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের রাজ্য হলেও, তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিও। ইতিমধ্যেই আইএসের মোকাবিলায় একটা সার্বিক নীতি তৈরির কাজ শুরু করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ একাধিক বার দাবি করেছেন, এ দেশের মুসলিম যুবসমাজে আইএসের বিশেষ প্রভাব নেই। কিন্তু কেন্দ্রের একটি অংশের মতে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই সংগঠনের কট্টরবাদী ভাবধারা ক্রমশ শিকড় ছড়াচ্ছে ভারতেও। তাই এ দেশে থাকা সমর্থকদের চাঙ্গা করতে উৎসবের সময়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও আইএস জঙ্গিরা হামলা চালাতে পারে বলে ইতিমধ্যেই রাজ্যগুলিকে সতর্ক করে দিয়েছে দিল্লি।
পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য অসমের সরকার আজ স্বীকারই করে নিয়েছে তাদের রাজ্যে আইএসের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ইন্টারনেটে আইএস সংক্রান্ত খবর নিয়ে আগ্রহের ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীর ও অন্ধ্রপ্রদেশের মতোই অসমও বাকি দেশের চেয়ে এগিয়ে। পুলিশের হাতে উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় সে ভাবে সাইবার-নজরদারি চালানো যাচ্ছে না। অসমের ডিজিপি খগেন শর্মা আজ জানিয়েছেন, মূলত পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলির কিশোর ও যুবকদের নিশানা করছে জেহাদিরা। গোষ্ঠী সংঘর্ষের শিকার বা বন্যায় ঘরহারাদেরও দলে টানার চেষ্টা হতে পারে। তাঁর ধারণা, সাধারণত আত্মঘাতী মিশনে বা সশস্ত্র নাশকতায় ব্যবহার করতে হলে কিশোরদের মগজ ধোলাই করা সোজা। তাই কিশোরদের উপরে নজর রাখার জন্য ও তাঁদের ভাল কাজে লাগাবার জন্য পুলিশ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। যদিও একই সঙ্গে ডিজিপির বক্তব্য, ‘‘রাজ্য থেকে কোনও যুবক এখনও আইএসে যোগ দেয়নি। জেহাদিরা রাজ্যে এখনও কোনও নাশকতাও করেনি। কিন্তু যে ভাবে আইএসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে ও অসমে জেহাদিরা গ্রেফতার হচ্ছে, তাতে আশঙ্কা বাড়ছেই।’’