কথায় বলে, ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয় আর ভবিষ্যৎ কেমন হবে সেই ভাগ্য নিয়ে কেউ জন্মান না। নিজের কর্মফলেই নাকি তা আয়ত্তে আনতে হয়। এই দুটো বাংলা প্রবাদই জীবন্ত হয়ে উঠেছে কল্পনা সরোজের জীবনে।
মহারাষ্ট্রের এক 'দলিত' পরিবারে জন্ম কল্পনার। ছোট থেকেই নানা সামাজিক এবং গার্হস্থ্য হিংসার মধ্যে বড় হয়ে উঠেছেন। কখনও বা তা মেনে নিতে না পেরে নিজের জীবনটাকেই শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের প্রকৃত অর্থ আর মূল্য বুঝতে পেরেছিলেন তারপর। অদম্য কর্মপ্রেরণা আর ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত একজন।
মাত্র দু’টাকা পারিশ্রমিকে এক কাপড়ের কারখানায় কাজ শুরু করা কল্পনা আজ ১১ কোটি ২০ লাখ ডলারের মালিক! কী ভাবে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরল? কী ভাবে দলিত পরিবার থেকে উঠে আসা কল্পনা কোম্পানির মালিক হয়ে উঠলেন? তাঁর কাহিনি এরকম আরও অনেক মেয়ের কাছেই অনুপ্রেরণা আজ।
মহারাষ্ট্রের ছোট্ট গ্রাম রোপারখেদায় জন্ম কল্পনা সরোজের। আকোলা থেকে আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটি। এই গ্রামে বেশিরভাগ পরিবারই দলিত। কল্পনার জন্মও এরমকই এক দলিত পরিবারে। শিক্ষা তো দূর অস্ত, সে সময় দলিত মেয়েদের কোনও স্বাধীনতাই ছিল না। বিয়েটা কী বিষয় তা বুঝতে শেখার আগেই শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের।
কল্পনার বাবা ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েকে অন্তত দশম শ্রেণি পাশ করাতে। কিন্তু সমাজের চাপে তা আর হয়ে ওঠেনি। স্কুলেও খুব অবহেলার শিকার হতে শুরু করেন তিনি। সহপাঠীরা কেউই তাঁর সঙ্গে বসতে চাইত না। খেতে বা খেলতেও চাইত না।
কল্পনা যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, সমাজের চাপে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে বাধ্য হন কনস্টেবল বাবা। পড়াশোনায় ইতি তখনই। মুম্বইয়ের একটা বস্তিতে স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতে শুরু করেন তিনি।
বিয়ের পর দিন থেকেই মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন শুরু হয় তাঁর উপর। ছোট মেয়েটাকে বাড়ির সব কাজ করতে হত, একটু এদিক ওদিক হলেই চলত মারধর আর তার উপর সারাদিন না খাইয়ে রাখা হত তাঁকে।
বিয়ের ছ’মাস পর মেয়েকে দেখতে শ্বশুরবাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন বাবা। কল্পনার তখন কঙ্কালসার চেহারা। প্রাণবন্ত মেয়েটা জীবন্ত মৃতের মতো হাঁটাচলা করছিল। সহ্য করতে না পেরে, সে দিনই তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে চলে এসেছিলেন তিনি। তারপর নিজের চেষ্টাতেই মেয়ের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করেন। মেয়েকে নতুন করে স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দেন।
সেখানেও বাধা ছিল সমাজ। চারদিক থেকে এত কুকথা শুনতে হত তাঁকে যে একদিন কল্পনা কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তবে ভাগ্য তাঁর জন্য অন্য কিছুই ঠিক করে রেখেছিল। তাই সে যাত্রায় শুধু বেঁচেই যাননি, বরং নতুন জন্ম পেয়েছিলেন তিনি।
এর পর মুম্বইয়ে কাকার বাড়িতে থাকতে শুরু করেন কল্পনা। প্রথমে একটা কাপড়ের কারখানায় দু’টাকার চাকরি নেন। খুব তাড়াতাড়ি কাপড় সেলাই রপ্ত করে সিনিয়র টেলর হয়ে যান দোকানের। সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু এর মাঝে তাঁর দিদির কঠিন রোগ ধরা পড়ে। টাকার অভাবে একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি।
জীবনে টাকার মূল্য কতখানি উপলব্ধি করেন কল্পনা। আরও বেশি উপার্জনের জন্য ঋণ নিয়ে সেলাই মেশিন কিনে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। ২২ বছরের এক স্টিল ব্যবসায়ী সমীর স্বরাজের সঙ্গে বিয়েও হয় তাঁর। কিন্তু দ্বিতীয় স্বামী খুব কম বয়সেই মারা যান।
এরপর আড়াই লাখ টাকা দিয়ে একটা জমি কিনেছিলেন। জমিটার আইনি সমস্যা ছিল, তাই কম দামে পেয়ে গিয়েছিলেন। দু’বছর ধরে লড়াই করে সেই সমস্ত আইনি সমস্যা মেটানোর পরই জমিটার দাম ২৫ গুণ বেড়ে ৫০ লাখ টাকা হয়ে যায়। এখান থেকেই ভাগ্যটা পুরোপুরি বদলে যেতে শুরু করে তাঁর।
তাঁর দক্ষতা দেখে মহারাষ্ট্রের কোম্পানি কামানি টিউবস-এর কর্মী সমিতি তাঁর দ্বারস্থ হয়। কামানি টিউবস ১৯৬০ সালে চালু হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের বিবাদের জেরে ১৯৮৫ সালে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
আর ২০০০ সালে কামানি টিউবস-এর কর্মী ইউনিয়ন তাঁর কোম্পানির দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন কল্পনার কাছে। প্রথমে খুব একটা ইচ্ছুক ছিলেন না কল্পনা সরোজ। কিন্তু কোম্পানির ৩৫০০ কর্মীর করুণ অবস্থার কথা তিনি বেশ অনুভব করতে পারছিলেন।
কোম্পানিটা কিনে নেন কল্পনা। কিছু সময়ের মধ্যেই খুব সুন্দরভাবে চালু হয়ে যায় কামানি টিউবস। বেচাকেনায় লাভও করতে শুরু করে। এগুলো ছাড়াও আরও অনেক সামাজিক কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করেন তিনি। কল্পনা সরোজ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।
২০১৩ সালে পদ্মশ্রীতে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। আর ২০০৬ সালে ‘রাজীব গাঁধী অ্যাওয়ার্ড ফর ওম্যান’ পান। ছোট গ্রামের দলিত মেয়েটাকে এখন সারা বিশ্ব চেনে।