সালটা ১৯২৫। অসম সাহিত্য সভার আসর বসেছে নগাঁওয়ে। নারী শিক্ষার প্রসার ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন সাহিত্য সভার সভাপতি মহাশয়। বাঁশের ব্যারিকেডে আলাদা ভাবে এক কোণে বসে থাকা কয়েক জন মহিলা সে সব শুনছেন।
আচমকা সেই বাঁশের ব্যারিকেড ভেঙে সোজা মঞ্চে উঠে এলেন এক মহিলা। জোর গলায় অন্য মহিলাদের ডাক দিলেন, ভেঙে ফেলা হোক ওই বাধা। সপাটে বললেন, এ ভাবে মেয়েদের এক কোণায় বসিয়ে রেখে নারীশিক্ষার ছেঁদো কথা বলে কোনও লাভ নেই। সবাই এক হয়ে এগিয়ে আসুন। মহিলার নাম চন্দ্রপ্রভা সৈকিয়ানি। তখন তাঁর বয়স ২৪ বছর।
অসমের ইতিহাসে অন্যতম নারীবাদী এবং নারীশিক্ষা প্রসারে প্রধান মুখ ছিলেন চন্দ্রপ্রভা। জীবনভর মহিলাদের শিক্ষা ও সমান অধিকারের জন্য লড়ে গিয়েছেন তিনি। ১৯০১ সালে অসমের কামরূপ জেলায় তাঁর জন্ম।
বাবা ঋতরাম মজুমদার ছিলেন গ্রামের প্রধান। সে কালের মানুষ ঋতরাম নিজে বিশ্বাস করতেন সমাজ এগবে তখনই, যখন মেয়েরা সমান শিক্ষার সুযোগ পাবে। নিজের মেয়েকেও বড় করেছিলেন তেমন ভাবেই।
চন্দ্রপ্রভার বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। খেলার বয়সেই বান্ধবীদের নিয়ে গড়ে ফেললেন একটা আস্ত স্কুল। নিজে স্কুলে গিয়ে যা পড়তেন, শিখতেন, ওই একচালা ঘরে দাঁড়িয়ে নিজের বয়সি মেয়েদের সেই সব বোঝাতেন। খেলার ছলে পড়াতেন সেই নাবালিকাদের, যাদের শিক্ষার কোনও সুযোগ ছিল না।
এক দুপুরবেলা ১৩ বছরের চন্দ্রপ্রভা মন দিয়ে পড়াচ্ছেন। সামনে বসে তারই বয়সি কয়েক জন নাবালিকা। তখনই ওই একচালা স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন পেশায় স্কুল সাব-ইনস্পেক্টর নীলকান্ত বড়ুয়া। ছোট্ট মাস্টারনির পড়ানোয় মুগ্ধ হয়ে বেশ খানিক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। তাকে রজনীপ্রভা স্কলারশিপ দিলেন তিনি।
স্কলারশিপ নিয়ে চন্দ্রপ্রভা ভর্তি হলেন মিশন স্কুলে। কিন্তু স্কুলে পড়তে গিয়ে এক অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলেন চন্দ্রপ্রভা। দেখলেন, হিন্দু আর খ্রিস্টান পড়ুয়াদের মধ্যে অদ্ভুত ভেদাভেদ। হিন্দু মেয়েদের তো ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান না হলে স্কুলের হস্টেলে থাকারই অধিকার নেই। এ কেমন নিয়ম! গর্জে ওঠে ১৪ বছরের বালিকা।
তখন তার বয়স ১৭ বছর। প্রথম ভরা মঞ্চে বক্তৃতা করতে উঠলেন চন্দ্রপ্রভা। বিষয়— আফিম নিষিদ্ধকরণ। আফিমের নেশা তখন ঘরে ঘরে। সেই নিয়ে নাবালিকার বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন বিশিষ্টরা। ছড়িয়ে পড়ল চন্দ্রপ্রভার নাম।
১৯২১ সাল। দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার। সেই জোয়ারে ভাসলেন চন্দ্রপ্রভাও। অসমের মহিলাদের সংঘবদ্ধ করার দায়িত্ব নিলেন তিনি। সেখান থেকে ১৯২৬ সালে তৈরি হল পুরোদস্তুর মহিলাদের সংগঠন। নাম— প্রাদেশিক মহিলা সমিতি। প্রতিষ্ঠাতা অবশ্যই চন্দ্রপ্রভা। আজ প্রায় একশো বছর হতে চলল সেই সংগঠনের বয়স। অসমে আজও নারীশিক্ষা প্রসার, নাবালিকাদের বিয়ে রোখা, মহিলা ক্ষমতায়নে কাজ করে এই সংগঠন।
মহিলা ক্ষমতায়ন নিয়ে তো বললেই চলবে না। দরকার ছাপা অক্ষর। এটা অনুধাবন করে শুরু করলেন ‘অভিযাত্রী’ পত্রিকার কাজ। যার সম্পাদক তিনি নিজেই। শুধু যে তিনি বাগ্মী তাই নন, এই পত্রিকার মাধ্যমে চন্দ্রপ্রভা নিজের লেখকসত্তারও পরিচয় ঘটালেন। ‘পিতৃভিটা’, ‘সিপাহী বিদ্রোহ’, ‘দিল্লির সিংহাসন’— একের পর এক বই লেখেন তিনি।
শুধু বাইরে নয়, ঘরেও সমান ‘বিপ্লবী’ চন্দ্রপ্রভা। বাবা-মা বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন। কিন্তু পাত্রের বয়স কেন এত বেশি? প্রশ্ন করে বিয়ে করতে বেঁকে বসলেন তিনি।
তত দিনে চাকরি পেয়েছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাকরি। কর্মসূত্রে থাকেন তেজপুরে। সেখানেই প্রেমে পড়লেন কবি ও লেখক দণ্ডীনাথ কলিতার। ভালবেসেছিলেন দণ্ডীনাথও। কিন্তু চন্দ্রপ্রভার মতো সাহসী তিনি ছিলেন না। চন্দ্রপ্রভা তাঁর সন্তানের মা হলেও বিয়ে করতে পারেননি। কারণ, দণ্ডীনাথের ‘নিচু জাত’। সামাজিক ভয়ে শেষমেশ বাবা-মায়ের পছন্দ করা এক মেয়েকেই বিয়ে করেন দণ্ডীনাথ।
সময়টা উনিশ শতক। সেই সময় দাঁড়িয়ে বিয়ে ছাড়া স্বামীর পরিচয়বিহীন এক মহিলা সন্তান পালন করেছেন, এটা ভাবাই ছিল অসম্ভব। কিন্তু চন্দ্রপ্রভার মতো মানুষরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। একা হাতে সন্তানকে বড় করে তুললেন তিনি। সমাজের টিপ্পনী, খেউড়, অপমান— কোনও কিছুই বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি তাঁর মনে।
বিপ্লবী মায়ের সন্তান তিনি। বড় হয়ে চন্দ্রপ্রভার ছেলে অসম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা হন। কংগ্রেস বিধায়কও হন। নিজে বিধায়ক হয়েও শ্রমিক শ্রেণির বঞ্চনা নিয়ে নিজের সরকারকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতেন তিনি।
আইন অমান্য এবং অসহযোগ আন্দোলনের জন্য দু’বার কারাবরণ করেন চন্দ্রপ্রভা। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম অসমিয়া মহিলা হিসেবে ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। যদিও ভোটে হেরে যান।
জাত-বর্ণের বিরুদ্ধে ছোট থেকে লড়াই তাঁর। ভালবেসেছিলেন এমন এক জনকে যাঁর সঙ্গে জাতের কারণে ঘর বাঁধতে পারেননি। সেই হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে শুধু মহিলাদের ক্ষমতায়ন নয়, চন্দ্রপ্রভা আজীবন লড়ে গিয়েছেন জাতপাতের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে।
১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ ৭১ বছর বয়সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় চন্দ্রপ্রভার। মৃত্যুর কিছু দিন পরে তাঁকে মরনোত্তর পদ্ম-সম্মানে ভূষিত করে কেন্দ্রীয় সরকার। মহিলাদের ক্ষমতায়নে নিরন্তর কাজ করে চলা, স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে গোঁড়া সমাজে থেকে একা মায়ের লড়াই, বিপ্লবের আর এক নাম চন্দ্রপ্রভা।