কাশ্মীর-কবি: নিঘাত সাহিবা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
তাঁর চেতনায় এখনও হানা দেয় দৃশ্যগুলো।
অনন্তনাগের পথে সাঁজোয়া গাড়িতে হিঁচড়ে টানা যুবকের দেহ কিংবা খামোখা সন্দেহে খুন পাড়াতুতো ভাইয়ের মুখ। ছোটবেলায় বাবা বেরোলেই ঘিরে ফেলা ভয়টাও ডাক দেয় আকছার। ‘‘বাবা দাড়ি রাখতেন যে! খুব ভয় করত সেনা যদি জঙ্গি ভাবে!’’ মঙ্গলবার দুপুরে বলছিলেন, ভূস্বর্গ-কন্যা, একাডেমি যুব পুরস্কারে ভূষিত কবি নিঘাত সাহিবা। কিন্তু কাশ্মীরের মেয়ে বলেই কবিতায় রক্তের স্রোত, মৃত্যু উপচে পড়বে কেন মাথায় ঢোকে না তাঁর।
অনন্তনাগের অল্পশিক্ষিত ব্যবসায়ী ঘরে, ছ’ভাইবোনের সংসারে কবিতা লেখাটাই যে স্পর্ধা— তা ক’জন বোঝেন! কিশোরীবেলায় প্রেমের কবিতা লেখার সময়ে দাদারা বকবে বলে কাঁটা হয়ে থাকত মেয়ে। উপত্যকার কবিসম্মেলনে তখন তিনি ছাড়া সক্কলে পুরুষ। কবিতা নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া! সেই মেয়েই এখন তাঁর কবিতার জোরে দিল্লি, মুম্বই, ইম্ফলে সাহিত্য উৎসবে ঘুরছেন। এ বারই প্রথম কলকাতায়! এ দিন সন্ধ্যায় অকালপ্রয়াত কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের নামে পুরস্কার পেলেন নিঘাত। আয়োজকদের তরফে কবি সুবোধ সরকার বলছিলেন, ‘‘এই মেয়েটির কবিতায় শান্ত, নরম একটা প্রতিবাদ আছে। অন্য রকম।’’
কাশ্মীরি কন্যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তাঁর ‘ইদের জামা’ কবিতাটি নিয়ে। ‘‘আশির দশকের শেষ দিকে উপত্যকাময় সংঘর্ষ। ছোটবেলায় কত ইদের উপোস, অপেক্ষাই তখন সার!’’ নিঘাতের কবিতার ইদের জামাটি তাই চিরঅধরা। স্বপ্নেই বোনা!
তবে কাশ্মীরের রাজনীতিতে কোনওদিকেই ঝুঁকতে পারেন না কবি। দু’চোখে টলটলে জল নিয়ে নিঘাত শোনাচ্ছিলেন, ’৯১ সালে কুনান, পোশপোরা গ্রামে শতাধিক নারীকে সেনাদের ধর্ষণের বিভীষিকাময় অভিঘাত। ‘‘আবার আমার বাবার হাতে বাড়ির চাবি রেখে যাওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিত পড়শিদের কথাও মনে পড়ে। কাশ্মীরে কেউ ভাবতে পারে, ইন্ডিয়ার পয়সা খেয়েছি, কিন্তু নিহত জওয়ানের ছবি দেখেও কিন্তু
আমি কাঁদি!’’ বাংলা গানে সীমান্তরক্ষীদের ‘দেশপ্রেমের দিনমজুর’ বলা হয়েছে শুনে খাতায় ইংরেজি করে লিখে রাখলেন কথাটা। ‘‘ওরাও তো চাকরিই করছে!’’
ছবি তোলার সময়ে মাথায় টেনে নেওয়া ওড়নাটা কখন খসে পড়েছে। পেশায় স্কুলশিক্ষক নিঘাত বলেন, ‘‘আমি শুধু শান্তির পক্ষে। কাশ্মীরি, উর্দুতে দেশহীন, সীমান্তহীন কবি। নিজেই বললেন, ওঁর শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’র ইংরেজি রূপ। ‘‘মনে-মনে রবীন্দ্রকবিতার সেই দেশটাকেই আমি খুঁজে চলেছি।’’
বলে গেলেন ভূস্বর্গের কবি।