ঠিক যেন টাইম মেশিন। এই গ্রামে গেলেই মনে হবে, বর্তমান থেকে হঠাৎ পিছনে চলে গিয়েছেন! একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও মনে হবে যেন বৈদিক যুগে এসে পড়েছেন।
বাস্তবে টাইম ট্রাভেলের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এই গ্রামে গেলে অনেকটাই বৈদিক যুগের আঁচ পেতে পারেন আপনিও। দেখবেন, আপনার আশেপাশে সকলেই প্রাচীন যুগের মতো পোষাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনকি একে অপরের সঙ্গে কথাও বলছেন সংস্কৃতে।
তাঁদের আচার-ব্যবহার, সংস্কারেও স্পষ্ট বৈদিক যুগের প্রভাব। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়ি ওই ধাঁচে বানানো। বাড়ির বাইরে সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিভিন্ন উক্তি। স্কুলে সংস্কৃত ভাষাতেই পড়ানো হচ্ছে। বাইরে স্কুলের নামটাও সংস্কৃত ভাষায় লেখা!
অবাক হচ্ছেন? আপাতদৃষ্টিতে টাইম ট্রাভেল মনে হলেও এটা বাস্তব। এটা ভারতের একমাত্র গ্রাম যেখানে এখনও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেন সকলে। কর্নাটকের সিমোগা জেলার মাত্তুর গ্রাম। তুঙ্গ নদীর ধারে এই গ্রামটির আকারও অদ্ভুত, একেবারে বর্গাকার।
গ্রামের মাঝখানে একটি মন্দির রয়েছে আর মন্দিরের পাশেই রয়েছে পাঠশালা। বৈদিক যুগে এই ধরনের পাঠাশালাতেই পড়াশোনা চলত। সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে মাত্তুর। পাঠশালায় পাঁচ বছরের জন্য সংস্কৃতের পাঠ নেওয়া এই গ্রামে বাধ্যতামূলক। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তালপাতায় লেখা সংস্কৃত হরফও সংগ্রহ করেন গ্রামবাসীরা।
গ্রামের সব্জি বিক্রেতা থেকে পুরোহিত, সকলেই সংস্কৃতে পারদর্শী। তুঙ্গ নদীর তীরে একদল পুরোহিত সংস্কৃত মন্ত্রচারণ করছেন, আর তাঁদের ঠিক পিছনে রাস্তা দিয়ে মোবাইলে সংস্কৃতে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছেন মানুষজন, এমন দৃশ্য এখানে ধরা পড়ে সহজেই।
মাত্তুরে শিক্ষিতের হারও খুবই ভাল। কর্নাটকের সিমোগা জেলার অন্য গ্রামের তুলনায় শিক্ষার হার অনেকটাই বেশি এখানে।
গ্রামবাসীদের দাবি, সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার পড়ুয়াদের অঙ্ক এবং যুক্তিবোধের বিকাশ ঘটায়। মাত্তুরের প্রতি পরিবারে অন্তত একজন ইঞ্জিনিয়ার! অনেকে বিদেশে পড়াশোনাও করেছেন।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে রোজকার জীবনে সংস্কৃত ভাষা, আচার-ব্যবহারের প্রয়োগ মোটেই সহজ নয়। এর শিকড় পোঁতা রয়েছে ১৯৮১ সালে। সংস্কৃত ভারতী নামে একটি সংস্থা এই গ্রামে ১০ দিনের একটি ওয়ার্কশপ করেছিল। সংস্কৃতের প্রচলনই ছিল এই সংস্থার উদ্দেশ্যে।
আগে মাত্তুরের মূলত সাঙ্কেথিরাই থাকতেন। তাঁরা সাঙ্কেথি ভাষাতেই কথা বলতেন। ৬০০ বছর আগে কেরালা থেকে প্রাচীন ব্রাক্ষ্মণ সমাজ এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। তাঁরাই সাঙ্কেথি বলে পরিচিত। সংস্কৃত, তামিল, কন্নড়, তেলুগু এই তিন ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলতেন তাঁরা। সেটাকেই সাঙ্কেথি বলা হত।
১০ দিনের এই ওয়ার্কশপই গ্রামের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। সংস্কৃতের প্রতি গ্রামবাসীদের কতটা আগ্রহ ছিল, তা ওই ওয়ার্কশপেই প্রকাশ পেয়েছিল। দলে দলে ওয়ার্কশপে যোগ দিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। সেই থেকেই শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ওই গ্রামে।
তার মানে এই নয় যে, গ্রামবাসীরা অন্য কোনও ভাষা শেখেন না। দৈনন্দিন জীবনে সংস্কৃতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন তাঁরা। পাশাপাশি ইংরাজি, কন্নড়ের মতো প্রয়োজনীয় সব ভাষাতেই সমান পারদর্শী তাঁরা।